দেশে খাদ্যশস্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় নেই। আজ আসছে মিয়ানমার থেকে আসবে ২০-২২ হাজার টন। দুই আড়াই মাসের মধ্যে চালগুলো পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে সবাইকে একটু সচেতন থাকতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে অধিক ক্রয় ও মজুদ না করলেই সকলে উপকৃত হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন, এনডিসি। বর্তমান খাদ্যশস্য মজুদ নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি অশোক দত্ত।
দেশে খাদ্যশস্য মজুদের কী অবস্থা এমন প্রশ্নের জবাবে ইসমাইল হোসেন বলেন, বর্তমানে খাদ্যের মজুদ সন্তোষজনক। সারাদেশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২ কোটি পরিবারকে সাশ্রয়মূল্যে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। ২ কোটি পরিবারে তথা প্রায় ৫-৬ কোটি পরিবার প্রধান খাদ্যসহায়তা পাচ্ছে। ৫০ লাখ পরিবার ১৫ টাকা কেজিতে মাসে ৩০ কেজি চাল পাচ্ছে। ওএমএসের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাচ্ছে। একজন ৫ কেজি করে কিনতে পারে। ভিজিএফ কার্ডধারীরা পাচ্ছে ৫ কেজি করে ১০ কেজি মাসে দুইবার।
ইসমাইল হোসেন বলেন, কিছু কার্যক্রম অন্য মন্ত্রণালয়ের কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু খাদ্যসংগ্রহ করে থাকে তাই সেটি আমরা দেখে থাকি। তার মধ্যে জেলেদের জন্য মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকাকালীন প্রণোদনা কর্মসূচি। তাদের প্রত্যেক পরিবার এক মণ করে চাল দেয়া হয়। টিআর-কাবিখা কার্যক্রম আছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কিছু কার্যক্রম আছে। ধান-চাল মিলে ১৭ লাখ মেট্রিক টন মজুদ আছে। মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টন খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হয়। চাল ১৫ লাখ টন, গম ২ লাখ টন মজুদ আছে। ধারাবাহিকভাবে এসব বেরিয়ে যাচ্ছে আবার সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খাদ্য সচিব আরও বলেন, বোরো মৌসুমের শেষে আমন আসার আগে কোনো সংগ্রহ নেই বাহির থেকে আমদানি করতে হয়। ১ নভেম্বর খাদ্যসংগ্রহ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে কী পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য প্রয়োজন তা নির্ণয় করা। যদিও খাদ্য মন্ত্রণালয় একটি খসড়া করেছে এটি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসা যাবে কী পরিমাণ খাদ্য কিনতে হবে। আগে আমাদের যে ১২ লাখ টন খাদ্য নিরাপত্তা ছিল বর্তমানে তার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। খাদ্য নিয়ে শঙ্কা থাকলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
সচিব বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মন্দা নিয়ে শঙ্কা আছে। তবে আমদানি করে এই শঙ্কা দূর করা হবে। আমদানির ব্যাপারে বেসরকারি পর্যায়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি শুল্ক কমিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি এখনো বলবৎ আছে। সরকার চাইলে এই সময় বাড়াতে পারে। এখন ৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে খাদ্য আমদানি করা হচ্ছে। ১৩-১৪ লাখ টনের আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক হিসেব দিতে পারবে।
খাদ্য সচিব বলেন, বর্তমানে হয়তো ৩ লাখ টন আমদানি হবে। কেননা অনুমতির প্রায় অর্ধেক আমদানি করা হয়ে থাকে। যেমন এর আগে ৬ লাখ টনের মতো আমদানি করা হয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হলে স্থিতিশীল থাকবে। সরকারি পর্যায়ে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির পরিকল্পনা আছে। তারমধ্যে ভারতের সঙ্গে এক লাখ টন, ভিয়েতনামের সঙ্গে ২ লাখ ৩০ হাজার ও মিয়ানমারের সঙ্গে দুই লাখ টনের চুক্তি হয়েছে। চালগুলো আসা শুরু হয়েছে। ভারত থেকে ২০ হাজার টন চলে এসেছে। স্থলবন্দর দিয়ে ৮-১০ হাজার টন অচিরেই আসবে। ২৪ অক্টোবর মিয়ানমার থেকে ২০-২২ হাজার টন এসেছে। দুই আড়াই মাসের মধ্যে চালগুলো পেয়ে যাবো।
খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, আমন সংগ্রহ শুরু হলে দেশের অভ্যন্তরে কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হবে। এ বিষয়ে দাম কী হবে তা মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সেটি বাস্তবায়ন করবে। আমনে কম ফলনের যে শঙ্কা ছিল সে সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রী বলতে পারবেন। তবে আমাদের মনে হয় ফলন মোটামুটি ভালো হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে আর কৃষক যদি আমনটি ভালোভাবে ঘরে তুলতে পারে তাহলে তেমন কোনো শঙ্কা থাকবে না। তা ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে পারে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ইসমাইল হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন তথা আবহাওয়ার কারণে এবার আগস্টে আমনের চারারোপন করতে পারিনি। যদিও এটি আগস্টের আগেই করতে হয়। বৃষ্টি ও সেচের সমস্যার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা ও আতঙ্কের কারণে চালে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এটি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। মূল্যা নির্ধারণ করে দিতে পারলে ভালো হয়। তবে এটি সময় লাগবে।
ব্যক্তি পর্যায়েও অধিক পরিমাণ না কিনতে আহ্বান জানিয়ে খাদ্যসচিব বলেন, মন্দার আশঙ্কায় প্রচুর খাদ্যদ্রব্য কিনে রাখে। আমাদের পরিচিত অনেকেই একসঙ্গে ৪ চার বস্তা চাল কিনে রাখে। তাতে ব্যবসায়ীরাও মুনাফা নেয় বাজারেও সংকট দেখা যায়। এসব না করে বরং অল্প অল্প করে কিনলেই ভালো। এটি যেন সবাই করে। কারো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবাইকে খাদ্য পৌঁছে দেয়া হবে। কেউ যেন মজুদদারী না করে ও নিজের প্রয়োজনেও বেশি না কিনে। এক মাসের মধ্যে বুলগেরিয়া থেকে এক লাখ ও রাশিয়া থেকে ৫০ হাজার টন গম সরকারিভাবে এসেছে। ইউক্রেন থেকে ৪০-৫০ হাজার টন গম আসবে। রাশিয়া থেকে আরো ৫০ হাজার টন গম আসবে। আর ভারতের গম বিক্রি বন্ধের কারণে সেখান থেকে আনা যাচ্ছে না।
অনেক ব্যবসায়ীকে অনুমোদন দেয়ার পরও তারা আনছে না, তারা অবাধ বাণিজ্য করে যাচ্ছে এদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মনিটরিং বা ব্যবস্থা নেয়া হবে কি- এ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, তারা কেন আনছে না সেই বিষয়ে কোনো মনিটরিং টিম নেই। অনেক ব্যবসায়ীকে সচিবালয় থেকে গিয়ে কাগজপত্র দিয়ে আসা হয়েছে। অনলাইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনুমতি দেয়া হয়। এই ধরনের সার্ভিস খুব বিরল। কেউ কেউ আনছেন। আবার অনেকে আনছে না। কেন আনছেন না প্রশ্ন করা হলে তারা জানিয়েছেন, অল্প তথা এক হাজার, দুই হাজার টন আনতে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
সচিব বলেন, তারা ভাবছেন নিজের চাল আনলে সরকার যদি ওএমএসের আওতা বাড়ায় তাহলে বিক্রি করতে পারবেন না। নানা ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। আমরা যা সাহায্য করছি। কয়েকজন মিলে ২ হাজার করে করে ১০ হাজার টন আনা যায় এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে আনতে প্রস্তাব করা হচ্ছে। সমাজের বৃত্তবানরা চিকন চাল খায়। ভালো দাম পাবেন বলেও তাদের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
ডিলাররা বিভিন্ন নামে লাইসেন্স করে চাল আনছে না সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যসচিব বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। বিভিন্ন নামে লাইসেন্স করা লোকদের। কেননা আমাদের পক্ষ থেকে যারা লাইসেন্স দেয় তারা গোডাউন ও এলসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দিচ্ছেন। গত বছরগুলোর কার্যক্রমও দেখা হয়। তবে এসব খতিয়ে দেখতে হবে। এখানে অনেক কিছু জড়িত। শুল্ক কমানোর দাবি ছিল তাদের এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে বলে শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে।