ঢাকা | শুক্রবার
২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অন্ধকারে ভয়-উৎকণ্ঠা

অন্ধকারে ভয়-উৎকণ্ঠা

বিদ্যুৎহীন ১৬ লাখের বেশি গ্রাহক

  • বেশি ঝুঁকিতে বরগুনা-পটুয়াখালী

ধেয়ে আসা সিত্রাং 

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পেড়েছে বাংলাদেশে। সকাল থেকেই উপকূলীয় জেলাগুলোতে শুরু হয় বৃষ্টিপাত। উত্তাল হয়ে উঠে নদি। পানি বন্ধি হয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি গ্রাম। রাজধানী ঢাকাতে গভির রাত থেকেই চলে টানা বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের নৌযান চলাচল। বাতিল করা হয় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি। বন্ধ ঘোষণা করা হয় উপকূলীয় অঞ্চলের ৩ বিমানবন্দর।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক হিসেবে কর্মরত মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, আন্দামান সাগরে ১৮ অক্টোবর একটি লঘু চাপ সৃষ্টি হয়েছিল যা উত্তর-পশ্চিম দিকে মানে মধ্য বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হয়ে ২১ অক্টোবর নিম্নচাপে ও ২৩ অক্টোবর দিনের শুরুতে গভীর নিম্নচাপে এবং এদিন সন্ধ্যা ৭ টার দিকে পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। গতকাল সোমবার ১০.৩০ মিনিটের সময় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কেন্দ্রের অবস্থান ছিল প্রায় ২১ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের উপরে। ফলে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের উপকূল থেকে ২০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান ছিল দুপুর ১২ টার সময়।

মোস্তফা কামাল পলাশ বলেছিলেন, আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের বৈজ্ঞানিক ও আবহাওয়াবিদদের তৈরিকৃত ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের গতিপথের সর্বশেষ চিত্র অনুসারে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বরিশাল বিভাগের সকল জেলা থাকতে পারে। আর চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার উপর দিয়ে অতিক্রম করার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দিকে আরও এগিয়ে এসেছে সিত্রাং। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ৭ নম্বর সংকেত দেওয়া হয়েছে। সিত্রাংয়ের প্রভাবে সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া শুরু হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে। ব্যাপক বৃদ্ধি নাফ-নদীসহ সাগরের পানি। আতংকিত হয়ে পড়ে সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপের মানুষ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢেউয়ের আঘাতে সেন্টমার্টিনে নোঙরে থাকা ১৫টি ফ্রিশিং ট্রলার সাগরে ডুবে গেছে। উড়ে গেছে দ্বীপের বেশকিছু ঘরের টিন-চাল । 

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সকাল থেকে প্রচণ্ড হাওয়া বইতে থাকে। ঢেউয়ের আঘাতে জেটিতে নোঙরে থাকা ১৫টি ফিশিং ট্রলার ডুবে গেছে। তার মধ্য দুটি ট্রলার সাগরে ভেসে গেছে। উপকূলের লোকজনকে সরিয়ে দ্বীপের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। কিছু ঘরবাড়ির টিন-চাল উড়ে গেছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ জানান, মহেষখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিনসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

সারাদেশে নৌ চলাচল বন্ধ

সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে বিআইডব্লিউটিএর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সমুদ্রে যেসব জাহাজ যেখানে অবস্থান করছে, সেখান থেকে না সরতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।

তিন বিমানবন্দর বন্ধ

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩ বিমানবন্দর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আবহাওয়ার পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর। গতকাল সোমবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আবহাওয়া পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের তিনটি বিমানবন্দরের উড্ডয়ন এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে উড্ডয়ন বা অবতরণ কার্যক্রম আজ ২৪ অক্টোবর বিকাল ৩টা হতে ২৫ অক্টোবর দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত  হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নোটাম জারি করা হয়েছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে পরবর্তিতে উড্ডয়ন কার্যক্রম পুনরায় চালু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আগেই বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি হিসেবে দেশের বিমানবন্দরের এপ্রোন এলাকার হালকা যন্ত্রপাতি সরিয়ে রাখা হচ্ছে। এয়ারলাইনগুলোকেও তাদের যন্ত্রপাতি নিরপদ স্থানে রাখতে বলা হয়েছে। যাতে ঝড়ে কোনও যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

দেশি এয়ারলাইনগুলো ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নিয়েছে। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে নভোএয়ার। বিকাল থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ফ্লাইট বাতিল করেছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, সাগর আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৭ (সাত) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরগুলোকেও ৬ (ছয়) নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) এয়ার কমডোর সাদিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, আবহাওয়ার পরিস্থিতি বিবেচনায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর সন্ধ্যা থেকে বন্ধ রাখা হবে। বিমানবন্দরগুলোতে পরিস্থিতি মোকাবিলায়  প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

বেশি ঝুঁকিতে বরগুনা-পটুয়াখালী

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে আছে বরগুনা ও পটুয়াখালী। গতকাল সোমবার দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এসব তথ্য জানিয়েছেন। ১৩টি জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী এবং ফেনীতে সিত্রাং মারাত্মক আঘাত হানবে বলে প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন । অর্থাৎ চট্টগ্রাম খুলনা এবং বরিশাল বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় এটি আঘাত হানবে এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দ্বীপ অঞ্চলগুলো বিশেষ করে মহেশখালী, সন্দীপ এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ আছে। প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের উপকূলের সব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শতভাগ মানুষকে সন্ধ্যার মধ্যে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে।

১৬ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর প্রভাবে রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে উপকূল অঞ্চলে। এর ফলে দেশের সাত জেলা এখন বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভোলাসহ সাতটি সমিতিরই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী এই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) জানায়, তাদের সব এলাকা ঝুঁকির মুখে নেই। তবে যে কয়টি জেলা পড়েছে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু আছে। তবে ঝড়ো হাওয়ার কারণে কিছু এলাকায় এমনিতে বিদ্যুৎ বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে।  আরইবি জানায়, সর্বশেষ আপডেট  অনুযায়ী আরইবির অধীন বরিশাল-১, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, খুলনা ও বাগেরহাট পিবিএস এর ১৬ লাখ ১২ হাজার গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় আছে।

আরইবির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের সাতটা পিবিএস ঝুঁকির মধ্যে আছে। তাই আপাতত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কিছু কিছু পিবিএস-এর হেড অফিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা হয়েছে। যদিও তার পরিমাণ খুবই অল্প। ভোলায় একেবারেই বিদ্যুৎ নেই। এই সাতটির বাইরেও বেশ কিছু পিবিএস ঝুঁকিতে আছে, যেমন কক্সবাজার। সেখানেও ঝড়ো হাওয়া বইছে। উপকূলের বেশিরভাগ এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সবগুলোই ঝুঁকিরমধ্যে আছে।

প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সিত্রাং মোকাবিলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলার অভিজ্ঞতা সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিয়েছি। মেরামতের সব ধরনের মালামাল, লোকবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফিডার ভিত্তিক কাজ বন্টন, লোকালের সাথে যোগাযোগ, টিম এরেঞ্জমেন্ট করা হচ্ছে। এছাড়া বলা হয়েছে, মোবাইলে কম কথা বলতে; যাতে করে চার্জ বেশিক্ষণ রাখা যায়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ভৌগোলিক এলাকা বাদে, খুলনা, বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুর বিভাগের ২১টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো।

কীভাবে ঝড় তৈরি

সমুদ্রের উষ্ণ পানির কারণে বায়ু উত্তপ্ত হয়ে হঠাৎ করে এসব ঝড়ের তৈরি হয়। তখন তুলনামূলক উষ্ণ বাতাস হালকা হয়ে যাওয়ার কারণে ওপরে উঠে যায়, আর ওপরের বাসা ঠাণ্ডা বাতাস নীচে নেমে আসে। এতে নীচের বায়ুমণ্ডলের বায়ুর চাপ কমে যায়। তখন আশেপাশের এলাকার বাতাসে তারতম্য তৈরি হয়। সেখানকার বাতাসের চাপ সমান করতে আশেপাশের এলাকা থেকে প্রবল বেগে বাতাস ছুটে আসে। আর এ কারণেই তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়ের। এর ফলে প্রবল বাতাস ও স্রোতের তৈরি হয়। যখন এসব এই বাতাসের ভেসে ঝড়টি ভূমিতে চলে আসে, তখন বন্যা, ভূমিধ্বস বা জলোচ্ছ্বাসের তৈরি করে। পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর।

সংবাদটি শেয়ার করুন