ঢাকা | রবিবার
১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্যোগে ঠিকানাহারা

দুর্যোগে ঠিকানাহারা

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অসংখ্য পরিবারের বসবাস জরাজীর্ণ কুঠিরে। আয়লা, সিডর, বুলবুল, আম্পান ও সর্বশেষ ইয়াসের তান্ডবে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। কারও জমি চলে গেছে নদীগর্ভে। নোনা পানিতে ভেসে গেছে কারো বাড়ি ঘর। দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই ফের নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে নষ্ট হয়ে যায় আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, সম্পদসহ জমির ফসল।

নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়া এখানকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন কয়েক হাজার পরিবার। প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবারের দুই-চার শতক জমি থাকলেও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। আবার কেউ সব হারিয়ে এলাকা ছেড়ে অবস্থান করছেন শহরের কোনো বস্তিতে। গত শুক্রবার কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে সরেজমিন গিয়ে ও খোঁজ নিয়ে এমন চিত্রের দেখা মেলে।

পৈত্রিক জমি সরকারি রাস্তায়, পাননি ক্ষতিপূরণ

আয়শা আক্তার। বয়স ৭৪। স্বামী মারা যান দেশ স্বাধীনের পূর্বে। এরপর থেকে বাপের ভিটায় থাকলেও এখন তার অবস্থান রাস্তার পাশের ঝুঁপড়িতে। সেখানেই একা বসবাস করছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। একমাত্র সন্তান পরিবার নিয়ে থাকেন বাগেরহাটের মোংলায়। অসুস্থ শরীরে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আয়ে কোনোরকমে দিনতিপাত করছেন তারা। হাঁস-মুরগী ও ছাগল-ভেড়া পালন করে অভাব-অনাটনের মধ্যে তার সংসার চলে। তবে ঘরের অভাবে সে ব্যবসায়ও ভাটি। নেই কোন শৌচাগার। খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামে তার জীর্ণ কুটিরে গিয়ে এমন চিত্রই চোখে পড়ে।

এসময় আয়শা আক্তার বলেন, বাপের বাড়ি থেকে ৭ কাঠা জমি পাই। এক কাঠা মাটি ভরাট করে আয়লার আগের বছর নাড়ার (ধানের অবশিষ্টাংশ) ছাউনী দিয়ে একটি ঘর তৈরি করি। আয়লার সময় নোনা পানিতে সেই ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফের ঘর তৈরি করে বেশ কয়েক বছর বসবাস করে আসছিলাম। গেল বছর একটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য মাটির বড় রাস্তা তৈরির সময় আমার পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর স্থাপিত ভাঙাচুরা ঘরটি সরিয়ে নিতে হয়। তবে জমি কিংবা ঘরের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তখন ইউএনও স্যার (পূর্বের ইউএনও অনিমেষ বিশ্বাস) কথা দিয়েছিলেন একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিবেন। মাত্র ২/৩টি হাঁস আছে, বাইরে রাখতে হয়। ছাগল-ভেড়া কোনো রকমে পাশের ঘরে রাখি। আমি এখানে একটা চৌকির ওপর ঘুমাই আর নিচেই চুলা পেতে রান্না করি।

ঝড়-বৃষ্টিতে কী করেন? জিজ্ঞাসা করতেই কষ্টের হাসি দিয়ে আয়শা আক্তার বলেন, এখন বুড়ো বয়সে তোমরা আমার খোঁজ নিতে এসেছো! গেল বছর ইয়াসের সময় পানি উঠলে রাস্তার ওপর বসবাস করেছি। এখন আর ভয় পাইনা। আতঙ্কেও থাকি না। জায়গা ভরাট করে একটি ভালো ঘরের ব্যবস্থা হলে কিছুটা বড় পরিসরে হাঁস-মুরগী ও ছাগল-ভেড়া পালন করে একটু স্বচ্ছলভাবে চলতে পারতেন বলে জানান তিনি।

ঝুঁপড়িতে তিন প্রজন্মের বসবাস

একই পরিবারের নয় সদস্যর সকলেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তবে পান না কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা। দু’জনের আয়ে ও ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যায় কোনো রকম। নেই মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও। ঝুঁপড়ির মধ্যেই রান্নার চুলা। দেখা মেলেনি শৌচাগারের। পেটে ক্ষুধা নিয়ে সরকারি জমিতে ছোট একটি ঝুঁপড়ি বেঁধে মেয়ে-জামাই, সন্তান, নাতি-নাতনি নিয়ে একসাথে থাকেন তিন প্রজন্ম।

একই উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের ফতেকাটি গ্রামের কপোতাক্ষ নদের বাঁধের পাশে এমনি একটি পরিবারের দেখা মেলে। সেখানে ৬ বছর ধরে বসবাস করছেন ৬৬ বছরের বৃদ্ধ সবুর শেখ ও ফাতেমা দম্পতি। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যেন তাদের কাছে নিতান্তই মরীচিকা।

ফাতেমা বেগম জানান, অভাব অনাটনে জর্জরিত হয়ে স্বামী ও তিন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে কয়রা ছেড়ে শহরে যান। সেখানে মেয়ের বিয়ের পর জামাই মেয়েও থাকতে শুরু করে তার পরিবারে। পরে মেয়ের কোলে একে একে এলো ৩ সন্তান, তারাও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। জীবিকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ৬ বছর পূর্বে পুনরায় ফিরে আসে তার জন্মভূমি কয়রাতে। সেই থেকে রাস্তার ধারে ঝুঁপড়ি বেঁধে বসবাস করে আসছে এই পরিবারটি। ছেলে ও জামাই দিনমজুরীর কাজ করেন। একটা ঘরের আশায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ বহু মানুষের শরণাপন্ন হয়েছেন পরিবারটি।

সবুর শেখের জামাই বলেন, আমাদের দুটি ঘর হলে অথবা একটু সরকারি জমি হলে সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রায় সবাই ভিক্ষা করে। আমি ও কুটুম (সবুরের ছেলে) শহরে কাজকর্ম করি। এ এলাকার সবাই চেনেন। এজন্য এর আশেপাশে ঘর হলে আমাদের সুবিধা হয়।

দু’যুগ কেটেছে জীর্ণকুটিরে

রাস্তার পাশে পলিথিন, খড় আর গোলপাতার ছাউনি মোড়ানো ছোট একটি ঘরে গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গেই বসবাস ভূমিহীন মনোয়ারা বেগম ও তাঁর স্বামীর। শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে মনোয়ারা বেগমদের জীর্ণ কুঠিরে। এই ঘরেই দুই যুগ কেটে গেছে তাদের। কয়রা উপজেলার ছয় নম্বর কয়রা ওয়াপদার রাস্তার পাশে ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছেন অসহায় দারিদ্র এ পরিবারটি। ম্বামী শাজাহান ঢালী দীর্ঘদিন অসুস্থ। নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে যে অর্থ উপার্জন করেন তা দিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে চালাচ্ছেন তাদের সংসার। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘আর কত গরীব হলে সরকারি অনুদান পাব বলতি পারো?’

বাগালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সামাদ গাজী বলেন, উপজেলার মিটিংয়ে বহুবার বলেছি। উপজেলা প্রশাসনের কাছে ঘরের জন্য  আবেদন দেয়া হলেও জমা নেননি। আমাদের ইউনিয়নে গুচ্ছগ্রাম থাকায় আর ঘর দেবেন না বলে জানানো হয়েছে। এখনও প্রায় দেড় শতাধিক গৃহহীন পরিবার রয়েছে।

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আমাদের ইউনিয়নে দুশ’র বেশি পরিবার রয়েছে যাদের ভালো ঘর নেই। অতি দারিদ্র পর্যায়ের হওয়ায় তারা ঘর বানাতে পারেন না। তাদেরকে ঘর দেওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, আমি নতুন এসেছি। ‘জমি নেই, ঘর নেই’ এমন স্বল্প কিছু পরিবার এখনও ঘর পাইনি। তারা পর্যায়ক্রমে ঘর বরাদ্দ পাবেন। আর ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এটা আগের প্রোগ্রাম ছিল। এখন যাদের কিছুই নেই তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রাস্তার সময় অসহায় বৃদ্ধার জমি ও ঘর নষ্টের বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো।

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর দেয়া হয়েছে। এখনও প্রায় তিনশ’ ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। আর ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এমন পরিবার রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার।

সংবাদটি শেয়ার করুন