ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১লা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা

রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা
  • সক্রিয় আরসাসহ একাধিক জঙ্গি সংগঠন
  • সন্ত্রাসী ঠেকাতে যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি

কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও মাদক-অস্ত্রের ঘাঁটি বানাতে আরসাসহ সশস্ত্র সংগঠনগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে ভয়ভীতি সৃষ্টি ও অস্থিরতা তৈরি করে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় আরসাসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো। এ কারণে চালাচ্ছে তারা সিরিজ হত্যাকান্ড।

উখিয়ায় শরনার্থী শিবিরে একটি দোকানের সামনে সর্বশেষ গত ১৫ অক্টোবর দু’জন রোহিঙ্গা নেতা যথাক্রমে ইউনুস ও হেড়মাঝি আনোয়ারকে হত্যার পর ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ চরম উৎকণ্ঠা। গত পাঁচ বছরে পারস্পরিক সংঘাত, দ্বন্দ্ব ও জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় এ পর্যন্ত ১২৩ জন হত্যা কান্ডের শিকার হয়েছেন। জোড়া হত্যায় জড়িত সন্দেহে এপর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ শিবিরের নিয়ন্ত্রণ নিতে এ ধরনের সিরিজ হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এদিকে, রোহিঙ্গা নেতারা এসব ঘটনার জন্য জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ী করছেন। তারা বলেছেন, নিরাপত্তহীনতার কারণে অসংখ্য রোহিঙ্গা এখন শিবিরের বাইরে গিয়ে বসবাস করছেন। টেকনাফ এবং উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিচালনায় সহায়তার জন্য প্রতিটি শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নির্বাচন করা হয়। যাদের বলা হয় মাঝি। রয়েছে সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৯ এর বি ব্লকের নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শিবির এলাকায় একটি দোকানের সামনে পনেরো বিশজনের একটি দল ধারলো অস্ত্র নিয়ে ঐ দু’জন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝির ওপর হামলা করে এবং সেখানেই তাদের দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। রোহিঙ্গারা ধারণা করছেন, এই দু’জনকে টার্গেট করেই হত্যা করা হয়েছে।

‘শিবিরে প্রভাব বিস্তারের জন্য রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা’: উখিয়া থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বা এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ মনে করেন এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রভাব বিস্তারের জন্য।

পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আদিপত্য বিস্তার ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিতে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে দুষ্কৃতিকারীরা। ঘটনা যাই হোক প্রশাসন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওপর নজরদারী বাড়িয়েছে পূর্বের চাইতে কয়েকগুন।

‘তারা (দুষ্কৃতকারীরা) তাদের প্রভাব এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য এগুলো করছে যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মাদক ব্যবসা, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার  চাঁদাবাজি, চোরাচালান, অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা,জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করা, বিদেশি সাহায্য রোহিঙ্গাদের নাম দিয়ে এনে সিংহ ভাগ লুটপাট করা ও প্রত্যাবাসনবিরোধী জনমত গড়ে তোলার  মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন মাধ্যমে ক্যাম্পে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।

ক্যাম্পে দায়িত্বে নিযোজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ানের অধিনায়ক সৈয়দ হারুনর রশীদ জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে শিবিরের পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। তবে জঙ্গি সন্ত্রাস, মাদক দমন ও আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার লোকজন ও তৎপর রয়েছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, শিবিরগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যার আগে আগে যখন এনজিও, সরকারি সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ক্যাম্প ছেড়ে আসেন তখনই তৎপর হয়ে উঠে অপরাধীরা। তিনি শিবিরগুলোতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, শিবিরগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

সৈয়দ হারুনর রশীদ বলেন, দিনে পরিস্থিতি শান্ত হলেও সন্ধ্যার পর থেকে অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়। ওখানে (রোহিঙ্গা শিবিরে) উগ্রবাদী কিছু লোক সক্রিয়। যদিও পুলিশ বলেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেট মূলত প্রভাব বিস্তার করে অবৈধ মাদক ব্যবসা করা আর অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা। কিন্তু মানবাধিকার কর্মী আনিসুল ইসলাম পরিস্থিতিটাকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসার মাধ্যমে মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায়, কিন্তু আরসাসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগীরা এগুতে চায় সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ দ্বন্দ্ব থেকেই এক বছর আগে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতাদের নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

‘রোহিঙ্গাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী আসলে চায় যত দ্রুত সম্ভব একটা শান্তিপূর্ণ পন্থায় তারা যেন মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারে। যখনই এই সাধারণ রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করতে চায় বা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, তখনই আরসা আক্রমণ করে। এছাড়া অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে, বলে উল্লেখ করেন মানবাধিকার নেতা ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দীন চৌধুরী।

পুলিশ সুপার মাহফুকুল ইসলাম বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি তারা করছেন। এছাড়া, তারা দাবি করেন, সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখাসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এদিকে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ট্রাস্ক ফোর্স গঠন করে সেনাবাহিনী, র‍্যাব,পুলিশ ও বিজিবি এবং জনপ্রতিনিদের নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে। যৌথ অভিযান পরিচালনা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যথাযত ব্যাবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। কারণ যেখানে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ও নিরাপদ নয় সে ক্ষেত্রে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে টলারেন্স অনুসরণ করা উচিত।

সংবাদটি শেয়ার করুন