রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা উখিয়া টেকনাফের গহীন অরণ্যে আবারও সংগঠিত হচ্ছে। ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলছে ধারাবাহিক হত্যাকান্ড। সর্বশেষ গত শনিবার আরো দুই জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় নিহত হন। টার্গেট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবক। উদ্দেশ্য মাদক ও অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা। এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চরম অস্থিরতা ও আতংক বিরাজ করছে। ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা দলে দলে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ অস্ত্রের ঝনঝনানি ও মাদকের আগ্রাসন রোহিঙ্গা শিবিরের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ২৫/৩০ টি সন্ত্রাসী গ্রুপের অবাধ বিচরণ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের।
হাতে হাতে অবৈধ অস্ত্র: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যমতে, প্রতিটি বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন সদস্য রয়েছে। ক্যাম্পে অধিক পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে মাস্টার মুন্না গ্রুপ, আলোচিত নবী হোসেন গ্রুপ, মৌলবি ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, মৌলবি আনাস গ্রুপ, কেফায়েত, জাবু গ্রুপ, আবু শমা গ্রুপ, লেড়াইয়া গ্রুপ, খালেদ গ্রুপ, শাহ আজম গ্রুপ, ইব্রাহিম গ্রুপ,সালামত উল্লাহ গ্রুপ, কামাল গ্রুপ, হামিদ গ্রুপ খলিল গ্রুপ প্রভৃতি।
সূত্র বলছে, এসব গ্রুপের নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা সালমত থাকেন চট্রগ্রাম, কক্সবাজারে। তিনি সকল গ্রুপের সমন্বয়ক। এ সব গ্রুপের অর্থ ও অস্ত্রের যোগানদাতা হচ্ছে এ সালামত। বিদেশিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে মানবিক সাহায্যের নামে তহবিল সংগ্রহ করে জঙ্গিবাদে ব্যয় করেন কোটি কোটি টাকা। তার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বলছেন ইতিমধ্যে তিনি ভোটার ও হয়েছেন। ব্যবহার করছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট। বছরে দুই তিন বার সৌদি,পাকিস্তান, আরব তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ সফর ও করছেন। ২০১৩ সালে তিনি পাকিস্তানি নাগরিক ও তার এক সহযোগীসহ চট্রগ্রমে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। চট্রগ্রাম কক্সবাজারের টি মাদ্রাসার নাম দিয়ে প্রতিবছর নিয়ে আসেন প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য। মূলত এ সব মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষার্থী রোহিঙ্গা বলে জানা গেছে। এমন কি এই রোহিঙ্গা নেতা শাইখ ছালামত উল্লাহর রয়েছে চট্রগ্রাম কক্সবাজারে ১০/১২টি বিলাসবহুল বাড়ি ও হোটেল। তার সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা।
ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব গ্রুপের কিছু সদস্যের নামও পাওয়া গেছে। তারা হলেন আবদু জব্বার, কামাল হোসেন, মৌ রিদোয়ান, নুরুল আমিন, শাহ আলম, কেফায়ত, নুরুন নবী, আবদুল হাকিম, সুলতান, জকির আলম, আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুকুর, শরীফ হোসেন, রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবুর রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসন শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত।
অভিযোগ আছে, নবী হোসেন, মাস্টার মুন্না গ্রুপসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিক্তিক বেশির ভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। ক্যাম্প অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ফ্রিতে দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মূলত বিশ্বের দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় মিয়ানমার।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৪ ধরনের অপরাধে ২ হাজার ৪৪০টি মামলা হয়েছে এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৮ হাজার ২৪৫ জন এই পাঁচ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫টি, মাদক উদ্ধার মামলা ১ হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ মামলা ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার মামলা হয়েছে ৩৯টি পাঁচ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২৩টি হত্যা মামলা হয়েছে ১০২টি। জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ৮ টি যদিও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে ১২২টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, মানব পাচারসহ ১৪ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গাদের নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৪ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪০টি এই সময়ে অস্ত্র উদ্ধার ৯৮টি, মাদক উদ্ধার ৮৭৪টি, ধর্ষণ ২৩টি ও হত্যা মামলা হয়েছে ৩০টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ এপিবিএন-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ক্যাম্পে অস্ত্রের চালান ঢুকছে কি না জানি না। তবে ক্যাম্পে হানাহানি ও সংঘাত বন্ধে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবাজ এবং ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এপিবিএন কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আগের চেয়ে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। অস্ত্র চালান ঢোকার তথ্যটি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, যে কোনো মূল্যে ক্যাম্প সন্ত্রাস, অস্ত্র ও মাদকমুক্ত করতে চান তারা। সেভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রোহিঙ্গাশিবিরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৬ এপিবিএন-এর অধিনায়ক এডিআইজি হাসান বারী নুর বলেন, ক্যাম্পে এপিবিএন পুলিশের তিনটি ইউনিটই সন্ত্রাসী, অস্ত্রাবাজি ও মাদক কারবার বন্ধে অভিযানের পাশাপাশি বিট পুলিশিং কাউন্সেলিং, সচেতনতা বৃদ্ধির সমাবেশসহ নানা ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি সংঘটিত খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা অপরাধীদেরও ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এবং ক্যাম্পের বাইরে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নির্মূল করার জন্য কাজ করছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। স্থানীয়দের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সামনে চলমান অভিযান আরও বেশি জোরালো হবে বলে উল্লেখ করে স্থানীয় যারা এসব সন্ত্রাসীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এসপি।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত শনিবার সন্ধ্যায় উখিয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হামলায় ক্যাম্প ১৯ এর ব্লক এ/১৮তে একটি দোকানের সামনে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে ক্যাম্প ১৩ এর এফ /২ ব্লকের বাসিন্দা সৈয়দ কাসিমের ছেলে ইউনুস ও একই ক্যাম্পের এফ ব্লকের নেতা হেড মাঝি আনোয়ার নিহত হয়েছেন।
আনন্দবাজার/শহক