ঢাকা | শনিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিয়ন্ত্রণের বাইরে

নিয়ন্ত্রণের বাইরে
  • যারা আইন মানছেন না তারাই ডাকাত: সিইসি
  • কমিশন ভবনে বসে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ভোটগ্রহণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত ইসি কীভাবে নিলো: মাহবুব-উল আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ 

উপনির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আইন ভঙ্গ করে গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচন নিয়ে এভাবেই অসহায় আত্মসমর্পণ করে কথাগুলো বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। দিনশেষে বাধ্য হয়ে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

এর আগে ৫০টি কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে জানান সিইসি কাজী হাবিবুর আউয়াল। তিনি বলেন, সকালে ভোট শুরু হয়। নির্বাচন ভবনে সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আমরা বসে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি, ভোটগ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেক গোপন কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি। অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট প্রদানে সহায়তা বা বাধ্য করছে- এটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি। যেটি নিয়ম নয়। তারপরেও আমরা দেখেছি, পোলিং এজেন্ট সম্ভবত তাদের অনেকের গায়ে যে পোশাক সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি, ওড়না ছিল যেটা নির্বাচন আচরণবিধির পরিপন্থী।

সিইসি আরও বলেন, অনিয়ম যেটা দেখছিলাম- আমাদের সহকর্মীরা সকাল আটটা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখেছি; কেউ কক্ষ ত্যাগ করেননি। এটা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অনিয়মগুলো বা ম্যাল প্র্যাকটিসেসগুলো মোটা দাগে হচ্ছিল। যার ফলে আমরা উপস্থিত থেকে প্রথমে তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছি। এরপরে ১৬টি কেন্দ্রে, তৃতীয় দফায় ১২টি; চতুর্থ দফায় ৯টি এবং সবশেষ আরও তিনটি, মোট ৪৩টি ভোটকেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিয়ে সাড়ে ১২টায় কক্ষ ত্যাগ করি।

সিইসি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করলাম- কতগুলো কেন্দ্রে সিসিটিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। যার ফলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। সবমিলিয়ে মোট ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেছি। রিটার্নিং অফিসারও একটি কেন্দ্রের ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে। এরপর আমরা কমিশনের সব সদস্য মিলে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে থাকি, বিশ্লেষণ করতে থাকি। আমরা নিশ্চিত হই, ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, ফলাফল- সব বিবেচনা করলেও আসলে সঠিক মূল্যায়নটা হবে না। এ পর্যায়ে আমাদের আরপিও ৯১-ই ধারা অনুযায়ী কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়, ভোট সঠিকভাবে হচ্ছে না।

সিইসি বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একটি পক্ষ বা একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা ৫১টি ভোট কেন্দ্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আইন কানুন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম- গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ অনুচ্ছেদে যে দায়িত্ব ইসিকে দেওয়া হয়েছে, ইসির কাছে এটা প্রতীয়মান হয় নির্বাচন সঠিকভাবে হচ্ছে না। যে কোনো কেন্দ্রে বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট কমিশন বন্ধ করে দিতে পারবে।

সিইসি বলেন, আমরা পরিশেষে এ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি—সমগ্রহ কন্সটিটিউয়েন্সি পুরো নির্বাচন গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। সে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েয়েছে (রিটার্নিং কর্মকর্তাকে)। ওখানে এখন আর ভোট হচ্ছে না। পরবর্তীতে বিধি বিধান অনুযায়ী কী করতে হবে দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবো।

সিইসি বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন কমিশন। আমরা ভোটটাকে সত্যিকার অর্থে ভোট হিসেবে দেখতে চাই। কিছু অনিয়ম দেখা গেছে, ওখানে সুষ্ঠুভাবে ভোট হতে দেখা যাচ্ছে না। এতে সঠিক জনমতের প্রতিফলন হবে না। সে কারণে আমরা ওই সেন্টারগুলোকে বাতিল করে দিয়েছি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা আমরা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। ইভিএমেরও কোনো ত্রুটি দেখতে পাচ্ছি না। ওই যে মানবিক আচরণ, আরেকজন ঢুকে যাচ্ছে, দেখিয়ে দিচ্ছে।

সিইসি আরও বলেন, আবার অনেকেই দেখছি গেঞ্জি পরে, শাড়ি পরে যেখানে প্রতীক আছে দেখিয়ে দিচ্ছে। তারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে এবং এটা সুশৃঙ্খল নির্বাচনের পরিপন্থি। এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত। যারাই আইন মানছেন না তাদেরই আমরা ডাকাত-দুর্বৃত্ত বলতে পারি। কারণ আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা করতে হবে। সবাই যদি আইন না মানি নির্বাচন কমিশন এখানে বসে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না।

এদিকে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণার আগেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়ম-জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেন অন্যান্য সব প্রার্থী। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা ভোটকেন্দ্রে একত্রিত হয়ে বাকি চার প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। তারা হলেন, জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু, বিকল্পধারা বাংলাদেশের কুলা প্রতীকের জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী আপেল প্রতীকের নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও ট্রাক প্রতীকের সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

এ সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মাহমুদ হাসান রিপনের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেওয়া, ইভিএমএ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ তুলে ভোট বাতিলের দাবি জানান তারা।

একই সঙ্গে আবার তফসিল ঘোষণা করে ভোটগ্রহণের দাবিও জানান প্রার্থীরা। আগে থেকেই সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কাসহ নানা অভিযোগ করে আসছিলেন তারা। এর আগে গোপন কক্ষে একজনের ভোট আরেকজন দেওয়াসহ নানা অনিয়ম-জালিয়াতির ঘটনায় একে একে ৪৫ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন।

গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। উপ-নির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ মোট ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে সাঘাটা উপজেলার ১০টি ও ফুলছড়ি উপজেলার সাতটিসহ মোট ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে মিলে ভোটার রয়েছেন তিন লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৩ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৭০ হাজার ১৬০।

স্থানীয় সূত্রমতে, বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বুথে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সকালে সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি ইউনিয়নের দহিছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের তিন সমর্থক আহত হয়েছেন।

জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থী এএইচএম গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, ভোটকেন্দ্র থেকে জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। তাদের কর্মী ও সমর্থকদেরও কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়। এ সব কারণে তারা একযোগে চারজন প্রার্থী ভোট বজনের সিদ্ধান্ত নেন।

এদিকে, কোনো কেন্দ্রেই অনিয়ম- নৈরাজ্য হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, কমিশন ভবনে বসে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এতগুলো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত ইসি কীভাবে নিলো তা বোধগম্য নয়।

এদিকে, গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণার প্রতিবাদে নির্বাচনী এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের অপসারণ ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সাঘাটা উপজেলা পরিষদ ঘিরে রাখে।

অন্যদিকে, পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। গতকাল  বুধবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে আজ সকাল থেকেই প্রায় শতভাগ কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর এজেন্টদের জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা। তারা ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে, আবার ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষে সন্ত্রাসীরা অবস্থান করে ভোটারের ইচ্ছের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।

এ সব কারণে, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গাাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেছে। এজন্য আমরা জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা গাইবান্ধা- ৫ আসনে তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, গত ২৩ জুলাই জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া আমেরিকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে আসনটি শূন্য হয়। এই আসনে মোট ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মাহমুদ হাসান, জাতীয় পার্টির প্রার্থী এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবার রহমান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মাহমুদ হাসান ছাড়া বাকিরা ভোটে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগে দুপুর ১২টার দিকে ভোট বর্জন করেন। সাঘাটা-ফুলছড়ি উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন।

সংবাদটি শেয়ার করুন