ঢাকা | শুক্রবার
৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্যাস সংকটে উৎপাদনে ভাটা

গ্যাস সংকটে উৎপাদনে ভাটা

করোনা মহামারির চাপ সামলে যখন ঘুরতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতির চাকা, ঠিক তখনই ডলার সংকটে পড়ে দেশ। কমে যায় দেশের রপ্তানি, কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়ায় আমদানি। আমদানি-রপ্তানির এই পার্থক্য এনে দেয় সর্বোচ্চ বাণিজ্যঘাটতি। ঘাটতি কমাতে ডলার খরচ করতে করতে এখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, জরুরি প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানিও করতে পারছে না সরকার। এতে কমে গেছে বিভিন্ন কল-কারখানার উৎপাদন। যা অকপটে স্বীকার করে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে (স্পট মার্কেট থেকে) গ্যাস আমদানিও করা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবীদরা বলছেন, সংকট ক্রমেই বাড়ছে। এই সংকট কতদিন চলবে তাও অজানা।

কারখানা মালিকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে যে লোকসান হচ্ছে, তাতে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যই লড়াই করতে হচ্ছে। শুরুতে করোনা মহামারির কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এরপর ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণেও ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। গ্যাসের আপদ এই ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গত জুলাইয়ে এলএনজি কিনতে পেট্রোবাংলার মোট ব্যয় ছিল প্রায় ২ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এসময় দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহকারীদের পাশাপাশি স্পট বাজার থেকে আমদানি করা দুটি চালান ডেলিভারি নেয় সরকারি সংস্থাটি। সে সময়ে জাতীয় গ্রিডে ৫৫০ থেকে ৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহকারী ও স্পট বাজার থেকে মোট ৯টি চালান আমদানি করা হয়। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে উভয় মাসেই মোট মাসিক আমদানি ব্যয় ছিল প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা করে; এসময় দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহ চুক্তির অধীনে থেকে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি চালান আসে দেশে।

স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলি থেকে সরবরাহ যখন গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন এলএনজি আমদানির মাধ্যমে সে ঘাটতি পূরণ শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু, করোনার কারণে সরবরাহ সংকটে বৈশ্বিক এলএনজি মূল্য বহুগুণে বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয় কমাতে সরকার খোলা বাজার (স্পট মার্কেট) থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মিটার ঘনফুট (এমএমসিএফ)। সরকারের নেওয়া এ সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী অসহনীয় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, এলএনজি আমদানির পরিমাণ কম থাকা সত্ত্বেও এলএনজি আমদানি বিল পরিশোধে প্রতিমাসে এক হাজার কোটি টাকা নগদ অর্থ ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে করপোরেশন। বর্তমানে, দেশের সর্বোচ্চ গ্যাস চাহিদা দৈনিক প্রায় ৩ হাজার ৬০০ এমএমসিএফ, যেখানে সরবরাহ মাত্র ২ হাজার ৬৭৫ এমএমসিএফ। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পসহ সব গ্রাহকই কম সরবরাহের ফলে পাইপলাইনে চাপ কম থাকার ভোগান্তিতে পড়েছে।

সিরামিকখাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। সিরামিক পণ্যের দেশীয় বাজারের আকার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সিরামিক শিল্পখাতের ২৫টির বেশি বৃহৎ কারখানা তিন মাসের বেশি সময় ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। ঢাকার সাভার ও ধামরাই; নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জের সিরামিক পণ্য, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার কারখানাগুলোতে দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ থাকছে না।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশই হয় গ্যাসে। অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। স্থানীয় বাজারেও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।

শুরুতে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়ার কথা থাকলেও বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া বেড়েছে কয়েকগুন। রাজধানীতেই এখন প্রতিদিন লোডশেডিং হয় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা করে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, শীত না আসা পর্যন্ত অক্টোবরেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। কারণ, চলমান ডলার সংকটের কারণে (স্পট মার্কেট থেকে) গ্যাস আমদানিও করা যাচ্ছে না।

গত সোমবার প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা যতই আশাবাদী হই না কেন, জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হারের দিক থেকে আমরা কমফোর্ট জোনে নেই। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জন্যও এলসি খোলা ও জ্বালানি আমদানির বিল মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এলএনজির বৈশ্বিক স্পট মার্কেট বা খোলাবাজারে গ্যাসের যোগান থাকলেও, সেখানকার দাম বাংলাদেশের জরুরি চাহিদা মেটানোর পক্ষে খুবই বেশি।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আগে তারা কারখানায় ৯-১০ পিএসআই গ্যাস প্রেসার পেতেন, যা এখন ১ থেকে ১.১ পিএসআই- এ নেমে এসেছে। গ্যাস সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরে কারখানায় উৎপাদন কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। সরকার যদি স্পট মার্কেট থেকে প্রায় ৩০০ এমএমসিএফ এলএনজি আমদানির জন্য মাসিক প্রায় ২০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করে, তাহলে রপ্তানি আয় দ্বিগুণ করে পোশাক শিল্প তা ফেরত দিতে পারবে। রপ্তানি শিল্পের উৎপাদন চাহিদা বজায় রাখতে আগামী ছয় মাস পর্যন্ত এ ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হবে। উদ্যোক্তারা বলছেন, চট্টগ্রামের পোশাক শিল্পে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ ২০ শতাংশ বেড়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন