ঢাকা | রবিবার
১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুপেয় পানির নতুন সম্ভাবনা   

সুপেয় পানির নতুন সম্ভাবনা   

দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, আর্সেনিক দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটছে। যে কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানীয় জলের সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। পানীয় জলের এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও প্রায়শই আন্তর্জাতিক দাতাদের সহযোগিতায় পিএসএফ, নলকূপ, বৃষ্টির জল সংগ্রহের ব্যবস্থা, ম্যানেজড একুইফার রিচার্জ, রিভার্স ওসমোসিস সিস্টেমের মতো বিভিন্ন পানীয় জলের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে। এরপরও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগছে। তবে এ ভোগান্তি ও সুপেয় পানির সঙ্কট নিরসনে কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস (সিএম প্লাস) মডেলের রূপরেখা কাজে আসবে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত “বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কমিউনিটি ভিত্তিক সুপেয় পানি অবকাঠামোর টেকসই শাসন : কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস মডেলের একটি কেস স্টাডি” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আইনুল ইসলামের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, ঢাবির প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান, ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক লিয়াকত আলী খান, ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ড দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ফকার দে জ্যাগার এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন চৌধুরী।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সকলের জন্য উন্নত এবং নিরাপদ পানীয় জলের দুর্লভতা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। অনুমান করা হয় যে, বিশ্বের দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এখনো নিরাপদ পানীয় জল পায় না। সমাজকে প্রভাবিত করে এমন শীর্ষ পাঁচটি বৈশ্বিক ঝুঁকির মধ্যে মিঠা পানির সঙ্কটকে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। বাংলাদেশে বহুবর্ষজীবী নদী থাকার পরও পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট রয়েছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় আরো এবং জনস্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। ডব্লিউএইচও-ইউনিসেফ জেএমপি (২০২১) এর তথ্যমতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ মানুষ নিরাপদে-পরিচালিত পানীয় জল পরিষেবাগুলো পাচ্ছে না।

বলা হয়, সিএম প্লাস মডেল হলো একটি শাসন ব্যবস্থা যেখানে পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ব্যবহারকারীদের এবং সরকারী বস্তবায়নকারি সংস্থা বা স্থানীয় এনজিওগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু এটি এখনো অনেকাংশে অজানা যে, কোন পরিস্থিতিতে কমিউনিটি পানীয় জলের ব্যবস্থা টেকসই পরিচালনায় সিএম প্লাস মডেলটি সফল হতে পারে। তাই, আমার গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কমিউনিটি ডিডব্লিউএস পরিচালনার ক্ষেত্রে সিএম প্লাস মডেলটি সফল হওয়ার পূর্বশর্তগুলি অন্বেষণ করা। আমি দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরাতে গবেষণাটি পরিচালিত করেছি। কারণ এই অঞ্চল গুলোতে পানীয় জলের ঘাটতি, কমিউনিটি পানীয় জলের ব্যবস্থার উপস্থিতি এবং ডিডব্লিউএস- পরিচালনায় এর সাফল্যে তারতম্য রয়েছে। এই গবেষণার জন্য আমি উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুটি কমিউনিটি পানীয় জলের ব্যবস্থা যেমন, পিএসএফ এবং ম্যানেজড একুইফার রিচার্জ নির্বাচন করেছি, যা এই এলাকাগুলোতে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

পানি ব্যবস্থাপনার গবেষক ড. বদরুল হাসান গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণে সিএম প্লাস মডেলটি নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে সফল হতে পারে বলে মত দেন। তিনি বলেন, নতুন পানি অবকাঠামোটি (ডিডব্লিউএস) স্থানীয় জনগণের চাহিদা এবং পছন্দের সাথে মিলে যায়। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো একটি ডিডব্লিউএস’র স্থানীয় জনগণের পছন্দ ঐ ডিডব্লিউএস’র বৈশিষ্ট্যসমুহ দ্বারা প্রভাবিত হয় যেমন- দুর্যোগ সহনশীলতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত, পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ, পানির স্বাদ। পাশাপাশি পরিবারের বৈশিষ্ট্য যেমন- পরিবারের ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবারের আকার, পরিবারের আয় ইত্যাদি দ্বারাও স্থানীয় জনগণের পছন্দ প্রভাবিত হয়।

এছাড়া, স্থানীয় জনগণ নতুন পানি অবকাঠামোর (ডিডব্লিউএস) গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। গবেষণায় পাওয়া যায় যে স্থানীয় জনগণের এই ইচ্ছা বিভিন্ন সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন- অনুমিত স্বাস্থ্যঝুঁকি, পানির দাম/খরচ, পানির স্বাদ, স্ব-কার্যকারিতা, এবং বিকল্প পানীয় জলের প্রাপ্যতা ও সংখ্যা ইত্যাদি। স্থানীয় জনগণ তাদের পানি অবকাঠামোটি পরিচালনায় একে অপরের সাথে এবং সরকারি সংস্থার সাথে যৌথকাজে অর্থপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত হতে সক্ষম।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, স্থানীয় জনগণ মাঝে এই যৌথ প্রয়াস/পদক্ষেপ কিছু ফ্যাক্টর দারা প্রভাবিত হয় যেমন- ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর আকার, ব্যবহারকারীদের মধ্যে আন্তঃনির্ভরতা, ডিডব্লিউএস বা পানি অবকাঠামোর উপর জনগণের নির্ভরতা, স্থানীয়ভাবে প্রণীত নিয়ম এবং সরকারী সংস্থার সাথে সহযোগিতা এবং পানি অবকাঠামো ব্যবহারকারীদের সাথে বহিরাগত সহায়তা সংস্থা যেমন ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় এনজিও এর সহযোগিতামুলক সম্পর্ক গড়ে ওঠা সক্ষম।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, ব্যবহারকারীদের সাথে বহিরাগত সহায়তা সংস্থার সহযোগিতামুলক সম্পর্ক কিছু ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন- স্পষ্ট নিয়মের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যবহারকারীদের সাথে বহিরাগত সহায়তা সংস্থার বিশ্বাস-নির্মাণ, এবং স্বচ্ছতা। উপরোক্ত ফলাফল বিশ্লেষণের পর ওই গবেষক পানি শাসন মডেলের জন্য সুপারিশ করেন।

ড. বদরুল হাসান বলেন, পানি শাসন মডেল যা বাংলাদেশ এবং অন্যত্র অনুরূপ প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি পানীয় জল ব্যবস্থার টেকসই কার্যকারিতা নিশ্চিত করবে বলে আশা করছি। আশা করি, আমার গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পানীয় জল ব্যবস্থার টেকসই কার্যকারিতার ফ্যাক্টরসমুহ বুঝতে সাহায্য করবে এবং এর ফলে বাংলাদেশে এসডিজি-৬ লক্ষ্য অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অর্জনে অবদান অবদান রাখবে।

মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সুপেয় পানি সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। ড. বদরুল হাসান যে গবেষণা করেছেন সুপেয় পানি নিয়ে এটা পানি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জন্য সুপেয় পানির জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে কাজ করা হচ্ছে। আমাদের অনেক পানি সম্পদ আছে। কিন্তু সুপেয় পানির সংকটও আছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে সুপেয় পানি মিলছেনা।বর্তমান সরকার মেঘনা নদী থেকে পানি নিয়ে পরিশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উপকুলীয় এলাকায় টিউবওয়েল ও গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ছে। এখন আমাদের জাতীয় লক্ষ্য হচ্ছে এসডিজি বাস্তবায়ন করা।

সংবাদটি শেয়ার করুন