ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১লা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাগছে ঘুমন্ত ভাইরাস

জাগছে ঘুমন্ত ভাইরাস
  • বিশ্বব্যাপী ফিরছে কলেরা বাড়ছে উদ্বেগ
  • জলবায়ুর প্রভাবে হামলে পড়ছে মহামারি

বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মে কলেরার কথা উঠে এসেছে। এই রোগের কারণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুই গ্রিক চিকিৎসকের লেখায় বহু আগেই গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় কলেরার মতো রোগের কথা উল্লেখ করা হলেও এই রোগটি প্রথম বৈশ্বিকভাবে মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে ১৮১৭ সালে। ওই বছর  বাংলাদেশের যশোরে এই রোগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যে তা বর্তমান ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

১৮২০ সাল নাগাদ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সে মহামারী আকারে এই রোগ দেখা দেয়। ওই সময় ইন্দোনেশিয়ার শুধু জাভা দ্বীপেই কলেরায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পরের বছর ইরাকের বসরায় তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রাণ হারান ১৮ হাজার মানুষ। এরপর আরব থেকে বাণিজ্য পথ ধরে পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা মহামারী।

দ্বিতীয় দফায় কলেরা বৈশ্বিক মহামারী আকারে দেখা দেয় ১৮২৯ সালে, ইউরোপ ও আমেরিকায় বিপুল প্রাণহানি ঘটায় এই সময়। ১৮৩০ সালে মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা, এরপর ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডে দেখা দেয় এই রোগ। বাণিজ্যপথ ধরে দ্রুতই তা জার্মানির হামবুর্গ এবং প্রথমবারের মতো ১৮৩১ সালে ইংল্যান্ডে দেখা দেয়। পরের বছর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। ১৮৩৩ সালে মহামারী শুরু হয় মেক্সিকো ও কিউবায়।

তৃতীয় দফা মহামারি হয় ১৮৫২ সালে এবং এবারই সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। ভারত থেকে শুরু হয়ে ইরান হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয় আফ্রিকা। এই দফায় ১৮৫৪ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে, শুধু যুক্তরাজ্যেই মারা যায় ২৩ হাজার মানুষ।

চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় কলেরা মহামারী শুরু হয় ১৮৬৩ ও ১৮৮১ সালে। আগের তুলনায় এই দুই দফায় রোগটির তীব্রতা কম হয় বলে ধরা করা হয়ে থাকে। তারপরেও ইউরোপের কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ১৮৮৪ সালে নেপলসের ৫ হাজারের বেশি বাসিন্দার মৃত্যু হয়, পরের বছর স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া ও মুরসিয়া প্রদেশে মারা যায় ৬০ হাজার মানুষ। ১৮৯৩-৯৪ সালে রাশিয়ায় দুই লাখের মতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় কলেরা। এই দফায় আবারও আক্রান্ত হয় জার্মানির হামবুর্গ, ১৮৯২ সালে সেখানকার ১.৫ শতাংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় কলেরা মহামারী। উনিশ শতকের চুতর্থ প্রান্তিকে চীন ও জাপানে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা মহামারী, ১৮৭৭ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে সেখানে ৯০ হাজার মানুষের মৃত্যু রেকর্ড হয়। ১৮৯০ দশকের শুরুর দিকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে।

এরপরও দুই দফায় কলেরা ছড়িয়ে এ পর্যন্ত সাতবার তা বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নিয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেও লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে কলেরা মহামারী। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এখনও প্রতি বছর এই রোগে প্রায় ৯৫ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে আবারও নতুন করে দেখা দিয়েছে এ মহামারি। ইতোমধ্যে ২৬টি দেশে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানা ধরনের ভাইরাসের সৃষ্টি হচ্ছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ করোনা ভাইরাস ও ওমিক্রন। ফলে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের রোগ। নতুন করে কলেরার এ আগমন কে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরুপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরে বিশ্বজুড়ে কলেরায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত ২০ সেপ্টেম্বর এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছে সংস্থাটি। ডব্লিউএইচও এক প্রতিবেদনে বলছে, বিশেষ করে দরিদ্র ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। বিশ্বের ২৬টি দেশে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত বাড়ছে কলেরায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর সংখ্যাও।

দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে কলেরা ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা মারাত্মক ডায়রিয়ায়ও ভুগতে পারেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার পর মাঝারি ধরনের উপসর্গ, এমনকি কোনো উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে। তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাফিলতি করা যাবে না। কারণ, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যেতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি।

ডব্লিউএইচওর কলেরা নিয়ে কাজ করা দলের প্রধান ফিলিপ বারবোজা বলেন, বছরের পর বছর ধরে কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমতে থাকলেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, গত বছর থেকে বিভিন্ন দেশে কলেরার প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এ বছরে কলেরায় গড় মৃত্যুহারও অনেক বেশি। এটা পাঁচ বছরের গড় মৃত্যুহারের প্রায় তিন গুণ। আর আফ্রিকায় কলেরায় আক্রান্ত প্রায় ৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

অন্য বছরগুলোতে সাধারণত ২০টির কম দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় অন্তত ৩৩ জনের কলেরায় মৃত্যু হয়েছে। এতে করে চরম স্বাস্থ্যগত হুমকির মুখে পড়েছে ১১ বছর ধরে চলা যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটি। সিরিয়া ছাড়াও কলেরা ছড়িয়ে পড়া আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ফিলিপ বারবোজা। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানও। দেশটির বড় একটি অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে।

ফিলিপ বারবোজা আরও বলেন, কলেরার ঝুঁকি কমানোর একটি কৌশল হতে পারে টিকাদান কর্মসূচি। তবে এটা স্পষ্ট যে তীব্র বা এর চেয়ে কম ভয়াবহ কলেরা প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট টিকা নেই। চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত দেয়ার জন্য আমাদের কাছে মাত্র কয়েক মিলিয়ন টিকা আছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন