নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে আগাম আলু চাষে ধুম পড়েছে। প্রতি বছর আগাম আলু চাষের কারণে এ এলাকাকে বলা হয় আগাম আলু চাষের সুঁতিগার। গত বছর এ উপজেলায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা গতবারের চেয়ে ১০০ হেক্টর বেশি ধরা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়া ও স্বল্পমেয়াদি আগাম আমন ধান ঘরে তুলে সেই জমিতে আগাম আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন শত শত কৃষক। আবহাওয়া ঠিক থাকলে আগামী ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করবে।
আলু চাষিরা জানান, সেভেন জাতের আগাম আলুর বীজ রোপন করা হচ্ছে। শীত মৌসুমের শুরুতে নতুন আলু ভোক্তাকে দিতে পারলে চড়া বাজারমূল্য পেয়ে দ্বিগুণ লাভবান হবেন এমন প্রত্যাশা করছেন আলু চাষিরা।
একটি সময় এ অঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক অভাবের মাস নামে পরিচিত ছিল। হাজার হাজার কৃষক ও কর্মজীবী মানুষ চরম অভাবের মাঝে পড়তে হয়েছিল। সেই দিন আর নেই।
কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা জানায়, চলতি বছরে এ অঞ্চলে আউশ ও আগাম ধান আবাদ করা হয়। এলাকার কৃষক এ ধানের নাম দিয়েছে মঙ্গা তাড়ানো আগাম ধান। এ ছাড়া আশ্বিন-কার্তিক মাসে এ ধান ঘরে তুলতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় কায়িক শ্রমিকদের। এ ছাড়া এ ধানের খড় গো-খাদ্যের চাহিদাও পূরণ করে। আগাম ধান ঘরে তোলার পর এখন সেই জমিতে কৃষক আগাম আলুর বোপনে নেমে পড়েছে।
উপজেলার উত্তর দুরাকুটি, নিতাই, মাগুড়া, পুটিমারী, কালিকাপুর এলাকায় দেখা যায়, আগাম ধানের কাটাই মাড়াই শেষে জমিতে আগাম আলুর বীজ বুনছেন কৃষক। চারিদিকে যেন ফসল উৎপাদনের উৎসব পড়েছে।
বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন বলেন, গত মৌসুমে সাড়ে ১১ একর জমিতে আলু চাষ করে ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলু পেয়েছিলেন। এর মধ্যে মৌসুমের শুরুতেই ৪০০ বস্তা বিক্রি করেন। ১ হাজার ১০০ বস্তা হিমাগারে রাখেন। উৎপাদন খরচ ও হিমাগার ভাড়াসহ প্রতি বস্তায় (৮৪ কেজি) খরচ পড়ে ৯৫০ টাকা। সেই আলু বস্তাপ্রতি তিনি বিক্রি করেছেন গড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে। লাভ বেশি পাওয়ায় এবার তিনি ২৫ বিঘা জমিতে আলু লাগানো শুরু করেছেন।
মাগুরা ইউনিয়নের কৃষক সাবেদ আলী জানান, বিঘা প্রতি জমিতে আগাম জাতের আলু রোপণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। বিঘায় আলু উৎপাদন হবে প্রায় আড়াই হাজার কেজি। আগাম আবাদে আগাম বাজার ধরতে পারলে আলুর কেজি বিক্রি হবে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এতে বিঘা প্রতি আলু বিক্রি করে খরচ বাদ দিয়ে লাভ পাওয়া যাবে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব দলিরাম গ্রামের কৃষি শ্রমিক শাহজাহান আলী জানান, আগে বেকার থাকতে হতো আর এখন আগাম উৎপাদিত ধান ও আলু খেতে কাজ করে প্রতিদিন ৫০০ টাকা মজুরি পাওয়া যাচ্ছে। একই কথা জানালেন আরও কয়েকজন শ্রমিক। তারা আরও জানালেন মৌসুমের শুরুতে নতুন আলু ভোক্তাকে দিতে পারলে চড়া বাজারমূল্য পেয়ে দ্বিগুণ লাভবান হবেন এমন প্রত্যাশা তাদের।
জেলা সদর ও জলঢাকা, উপজেলায় দেখা গেছে আগাম আলু চাষ চলছে। রণচন্ডি ইউনিয়নের কুটিপাড়া এলাকার কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, এ বছর ৫ বিঘা জমিতে আগাম আলু রোপণ করেছেন। একই এলাকার রিকুল হোসেন আগাম আলু চাষ করেছেন ৫ বিঘা জমিতে। তিনি বলেন, আমাদের এদিকের ডাঙ্গা জমিগুলো একদম উঁচু এবং বালুমিশ্রিত। ভারি বৃষ্টিপাত হলেও তেমন ভয় থাকে না। তাই আগেভাগে দ্বিগুণ লাভের আশায় আগাম আলু চাষ করছি।
নীলফামারীর সদরের যাদুরহাট গ্রামের কৃষক ইউনুছ আলী ৩০ বিঘা জমিতে আগাম ধান আবাদের পর ওই পরিমান জমিতে আগাম আলু চাষ করছেন। তিনি বলেন, আমি আগাম ধান ও আগাম আলু চাষ করে দ্বিগুন লাভ পাচ্ছি। আলুচাষি কামরুল ইসলাম বলেন, গত বছর ৫ বিঘা জমিতে ৫৯ বস্তা ফলন পাই। যা উত্তোলন করে ৯০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করে খরচ বাদে ২ লাখ টাকা আয় হয়েছে। এবার ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। এখন নীলফামারী সহ উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলের জেলা, উপজেলা এ আগাম আলু চাষ করা হচ্ছে। অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভ হওয়ায় এ ফসলের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। ফলে মঙ্গাও পালিয়েছে। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না এসব এলাকার মানুষকে।
রণচন্ডি ইউনিয়নের কুটিপাড়া এলাকার কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, এ বছর ৫ বিঘা জমিতে আগাম আলু রোপণ করেছি। আগুর (নির্দিষ্ট সময়ের আগে) আলু উত্তোলন করতে পারলে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বাজার ধরা যাবে। গত বছর ধান কাটার পর এই জমিতে চাষ করা আলু ক্ষেতে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে বিঘায় লাভ করেছি ৪০ হাজার টাকারও বেশি। একই এলাকার রিকুল হোসেন আগাম আলু চাষ করেছেন ৫ বিঘা জমিতে। তিনি বলেন, আমাদের এদিকের ডাঙ্গা জমিগুলো একদম উঁচু এবং বালুমিশ্রিত। ভারি বৃষ্টিপাত হলেও তেমন ভয় থাকে না। তাই আগেভাগে দ্বিগুণ লাভের আশায় আগাম আলু চাষ করছি।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, চলতি বছর ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ১০০ হেক্টর বেশি। এ বছর আগাম আমন ধানে রেকর্ড পরিমাণ ফলন পেয়ে কৃষক আলু চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উঁচু জমিতে আলুচাষে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নিচু জমিতে আবহাওয়া দেখে রোপণের কথা বলা হচ্ছে। এ উপজেলার অন্যতম আকর্ষণ আগাম আলু ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে বাজারে চলে আসবে। আশা করছি ভালো ফলন ও চড়া বাজার মূল্য পেয়ে কৃষক পরিবারে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। আগাম ধান, আগাম আলু চাষে এ জনপদে অভাব এখন অতীত।