প্রকৃতির সৌন্দর্যের মুকুট ‘রাজার পাহাড়’
‘রাজার পাহাড়’ নামটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক রাজকীয়ভাব। বলছিলাম, পাহাড় ও নদীঘেরা শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী সিঙ্গাবরুণা ইউনিয়নের কর্ণঝোরা গ্রামের রাজার পাহাড়ের কথা। যার সৌন্দর্য্যের মুকুট এখন প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোল ঘেঁষা অবারিত সবুজের সমারোহ নিয়ে এ গারো পাহাড়ের অবস্থান। ছোট-বড় অসংখ্য টিলাভূমি, চোখ জুড়ানো সবুজে ঘেরা গারো পাহাড় কত যে মনোমুগ্ধকর তা নিজের চোখে না দেখলে অনুভব করার নয়।
নামের আদি কথা
জনশ্রুতি রয়েছে, এক সময় গারো নৃ-গোষ্ঠির রাজারা এ পাহাড়ে রাজত্ব করতেন। টিলার বিশাল সমতল ভূমিতেই ছিল তাদের বাসভবন ও কাচারী। উপর্যুপরি বুনোহাতির আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজার বাড়ি ও কাচারী ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই রাজার কোন বংশধরকে এখানে আর পাওয়া না গেলেও ধীরে ধীরে ওই পাহাড়টি স্থানীয়দের কাছে রাজার পাহাড় নামেই পরিচিতি লাভ করে। রাজার পাহাড়ের পাশে বসবাসকারি হিমু মারাকের মতে, টিলার সমতল ভূমিতে ভরাট হয়ে যাওয়া একটি পুকুরের বাঁধানো ঘাটলার কিছু অংশ তাদের পূর্ব পুরুষরা দেখেছেন।
স্থানীয় হাজং সম্প্রদায়ের মিরু হাজং জানান, ১৯৮০ সালে পাগলা দারোগা নামে এক ব্যক্তি রাজার পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি মারা গেলে তার সন্তানরা এখানে রয়েছেন। তারা এ টিলার এক কোনায় গড়ে তুলেছেন কাঁঠাল, লিচু ও কলার বাগান।
রাজার পাহাড়ের সৌন্দর্য্য
গারো পাহাড়ে যতগুলো পাহাড় রয়েছে তার মধ্যে রাজার পাহাড়ের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। অপূর্ব সৌন্দর্য্যমন্ডিত এ পাহাড়ের চারদিকে রয়েছে হরেক প্রজাতির গাছ-গাছালি। পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল সমতলভূমিতে যেতে সরু পথ আর অদ্ভুত নির্জন পরিবেশ যে কাউকে যাওয়ার আগে মুগ্ধ করবে। এখান থেকে মেঘালয় যেন আরো কাছে মনে হয়। এর চূড়া সবুজ আর নীলের সংমিশ্রণে যেন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। আঁকাশ ছোয়া বিশাল পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য, মনকে করে আবেগ তাড়িত। রাজার পাহাড় ঘেঁষা গ্রাম বাবেলাকোনা। গ্রামটি অসংখ্য উঁচু-নিচু টিলায় ঘেরা।
প্রাচীনকাল থেকে এখানে গড়ে উঠেছে জনবসতি। ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত্ত গ্রামটি কালের আবর্তে পরিবর্তিত। গারো, হাজং, কোচ অধ্যুষিত গ্রামটি উপজাতি সংস্কৃতির ভিন্ন মাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা। এ যেন জঙ্গল আর জন্তু-জানোয়ারের নৈসর্গিক মিতালি। এখানকার চলমান জীবন সংগ্রামের বিরল দৃশ্য, উপজাতি সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চার কেন্দ্রগুলোও যেন আলাদা আকর্ষণ। আর কালচারাল একাডেমি, ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফিস, জাদুঘর, লাইব্রেরি, গবেষণা বিভাগ, মিলনায়তন এর অন্যতম নিদর্শন।
এখান থেকে উপজাতিদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হচ্ছে এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্ষাকালে ভারত থেকে নেমে আসা জোয়ারের পানি ঢেউফা নদীর কানায় কানায় ভরে উঠে। কিন্তু দিনের শেষে তা ভাটা পড়ে। শুকিয়ে যায় এ নদীর পানি। তবে খরস্রোতা এ নদীর পানির গতি কখনোই কমেনা। সারা বছরই হেঁটে পার হওয়া যায়। ক’বছর ধরে এ নদীর দু’পাশে দুটি ব্রিজ নির্মিত হওয়ায় এখন আর নদীতে নামতে হয়না। এর বুক জুড়ে বিশাল বালুচর। যেন রাজার পাহাড় থেকে পাশ্ববর্তী গ্রাম বাবেলাকোনা পর্যন্ত কোল ঘেষা বিকল্প সমুদ্র সৈকত।
এখানে রয়েছে উপজাতিদের কারুকার্য মণ্ডিত ধর্মীয় গীর্জা, মন্দিরসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক নিদর্শনের সমাহার। উপজাতিদের চালচলন, কথাবার্তা ও জীবনপ্রণালী দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। তাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা। এদের জীবন যেন প্রবাহিত হয় ভিন্ন ধারায়। এখানে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ভিশন, বিট অফিস, বিজিবি ক্যাম্প এবং রাবার বাগান।
আসা যাওয়া
দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যানবাহনে করে শেরপুর আসা যায়। জেলা শহর থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে শ্রীবরদীর কর্ণঝোরা বাজার। সেখান থেকে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, সিনজি অটো রি, টেম্পুসহ বিভিন্ন যানবাহনে আসা যায় মনোমুগ্ধকর নয়ানিভিরাম স্থান রাজার পাহাড়ে। পাশেই রয়েছে অবসর কেন্দ্র। রাতে সেখানে থাকার জন্য রয়েছে নিরাপত্তাবেষ্টিত আবাসিক ভবন। কম খরচে, কম সময়ে গারো পাহাড় ভ্রমণ আপনাকে দেবে অনাবিল আনন্দ।
স্থানীয়দের দাবি
রাজার পাহাড় এলাকার দখলদারদের উচ্ছেদ করে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে এখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আসতেন। এখানকার ৯১০ একর আয়তনের বিশাল এ সমতল টিলায় পর্যটন করপোরেশন, জেলা প্রশাসন কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।