দেখিয়ে দিলেন আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
২৫ প্রকারের অভিযোগের ফিরিস্তি
প্রধান প্রধান অভিযোগ–
- সরকারি অনুদান আত্মসাৎ
- সভাপতির স্বাক্ষর জাল করা
- টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ
- স্ত্রীকে অবৈধভাবে নিয়োগদান
- হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য
- মনগড়া রুটিনে ক্লাস করা
- ৫ শিক্ষককে ইচ্ছেমত ছুটি
- স্কুলের গেটে নিজের নাম
বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্ত এই প্রধান শিক্ষক: জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, দাতা সদস্য, আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়
দুর্নীতির দায়ে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ক্ষমা চেয়ে কিছু টাকা ফেরতও দেন: আবুল হোসেন ভূঁইয়া, বিদ্যোৎসাহী সদস্য, আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়
এটা আমার স্কুল। আমি টাকা খরচ করবো না, কে করবে: জালাল আহাম্মেদ, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক, আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়
অভিযোগের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় হবে: নাছির উদ্দিন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, নাঙ্গলকোট
নাম তার জালাল আহাম্মদ। একজন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক। থাকেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায়। ১৯৯৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন উপজেলার আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে ভালো চললেও বছর কয়েক পর প্রধান জালাল আহাম্মাদ জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে। তার বিরুদ্ধে একের পর এক নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। তবে সব অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি বহাল তবিয়তে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
অবশেষে ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর চার পৃষ্ঠার এক ঢাউস অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে চাকরিচ্যুৎ করা হয়। তখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয় শিক্ষক গোপাল চন্দ্র দাসকে। তবে ঘটনার প্রায় চার বছর পাঁচ মাস পর গত ২০২১ সালে ২৯ মার্চ আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আলহাজ্ব আবু বক্কর সিদ্দিক ভূইয়া মৃত্যুবরণ করলে তৎপর হয়ে ওঠেন জালাল আহাম্মদ। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে অবশেষে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। সেই সঙ্গে নিজের অবস্থান পাকা করতে বিদ্যালয়ে এডহক কমিটিও গঠন করেন।
স্থানীয় সূত্রমতে, প্রধান শিক্ষক জালাল আহাম্মদের বিরুদ্ধে অন্তত ২৫টি অভিযোগ তুলেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। সব সদস্যের সম্মতিতে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি আবু বক্কর ছিদ্দিক ভূইয়া এসব অভিযোগ লিখিত আকারে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, বিদ্যালয় পরিদর্শক, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসার, নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে দায়ের করেছেন।
প্রধান শিক্ষক জালাল আহাম্মদের বিরুদ্ধে অন্তত ২৫টি অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগগুলো হলো-
১. অর্থ আত্মসাৎ করা
২. সরকারি অনুদান আত্মসাৎ করা
৩. সভাপতির স্বাক্ষর জাল করা
৪. স্ত্রীকে অবৈধভাবে নিয়োগদান
৫. দলীয় প্রভাব খাটানো
৬. বরখাস্তের পরও অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষকের পদে থাকা
৭. এক বিষয়ের তিন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া
৮. হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে স্কুলের কমিটি গঠন
৯. এসএসসির ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়
১০. প্রবেশপত্র বিতরণে বিনা রশিদে টাকা আদায়
১১. নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনে বিনা রশিদে অতিরিক্ত অর্থ আদায়
১২. মনগড়া রুটিনে ক্লাস করা
১৩. স্কুলে না আসা শিক্ষকের বদলে খণ্ডকালিন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করানো
১৪. ইচ্ছেমত ৫ শিক্ষককে ছুটি দেওয়া
১৫. স্কুলের গেটে নাম পরিবর্তন করা
১৬. পরিত্যক্ত মালামাল বিক্রির টাকা নিজে আত্মসাৎ করা
১৭. চার বছর ৫ মাস বহিষ্কার থাকার পরও বেতন-ভাতা উত্তোলন
১৮. টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ
১৯. দুই আত্মীয়কে খণ্ডকালিন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ
২০. নিজ ক্ষমতাবলে স্কুল দুইদিন বন্ধ রাখা
২১. সিসি ক্যামেরা ক্রয়ে দুর্নীতি
২২. স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভূয়া রেজুলেশন তৈরি করা
২৩. স্কুল বন্ধের দিনে শিক্ষক হাজিরা খাতায় উপস্থিতির স্বাক্ষর নেওয়া
২৪. প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দায়ের করা ব্যয় বিদ্যালয় ফান্ড থেকে খরচ
২৫. রেজিস্ট্রারে অপ্রত্যাশিত খাত দেখিয়ে স্কুল ফান্ড থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব আলী আক্কাস ভূইয়া ১৯৮৪ সালে আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিদ্যালয়টি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। প্রায় বছর দশেক পর ১৯৯৫ সালের ১ এপ্রিল সেই বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন জালাল আহাম্মদ। তার যোগদানের কিছুদিন পর থেকেই ধীরে ধীরে নানা অনিয়ম দুনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
জালাল আহাম্মদের হাত ধরে বিদ্যালয় প্রশাসন নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এসব অনিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর বিদ্যালয়ের হিসাব নিরীক্ষা করে দেখা যায় প্রধান শিক্ষক জালাল আহাম্মদ বিদ্যালয়ের সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে তিন লাখ ৩৯ হাজার ৩৬ টাকা আত্মসাৎ করেন। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে তিনি এ জন্য ভূয়া রেজুলেশনও তৈরি করেন।
এরপর ২০১৬ সালে এসে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা না নিয়েই উত্তরপত্র কেনা ও পরীক্ষার হল পর্যবেক্ষণ ভাতার টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। তাছাড়া বিদ্যালয়ে সিসিটিভি ক্যামরা কেনা বাবদ অতিরিক্ত টাকার ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন। একই বছরে এসএসসি পরীক্ষার্থী জনৈক নাজমুন নাহার ও পরের বছর ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী জনৈকি আব্দুল্লা আল মামুনের কাছ থেকে ফরম পূরণের টাকা নিয়েও ফরম পূরণ করেননি প্রধান শিক্ষক।
জালাল আহাম্মদ স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়ে ২০১৭ সালের ২৩-২৪ জুলাই দুদিন নিজের ইচ্ছেমতো বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ রাখেন। সেই বন্ধের দিনে শিক্ষক হাজিরা খাতায় উপস্থিতির স্বাক্ষরও নেন। বিষয়ভিত্তিক প্যাটার্ন তৈরি না করেই শিক্ষক নিয়োগ দিতে থাকেন। সমাজ কল্যাণের বিষয়ে দুজন শিক্ষক থাকার পরও সমাজকল্যাণের ওপর পড়াশোনা করা তার স্ত্রী কামরুন্নাহারকে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে তাকে দিয়ে সমাজকল্যাণের ক্লাস করাতে থাকেন। তাছাড়া বিদ্যালয় ফান্ডের টাকায় খণ্ডকালিন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তিনি ইংরেজি বিষয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন।
প্রধান শিক্ষক জালাল আহাম্মদের এসব বহুমুখী অনিয়ম দুনীতির কারণে বিদ্যালয় সভাপতি তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। তবে কয়েক মাস অপেক্ষার পরও সেই নোটিশের কোনো জবাব পেতে ব্যর্থ হন। অবশেষে অবশেষে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যের সম্মতিতে জালাল আহম্মেদকে ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত করেন। সেই বরখাস্তপত্রের অনুলিপি শিক্ষাবিভাগের সব দপ্তরে পাঠিয়ে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, অতি কৌশলী ওই প্রধান শিক্ষক ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে কৌশলে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে দেন। পরে দুর্নীতির দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে সভাপতির কাছে পুনর্বহালের আবেদন করেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আলহাজ্ব আবু বক্কর সিদ্দিক ভূইয়া ২০২১ সালের ২৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
তবে সভাপতির মৃত্যুর খবর শুনেই তাড়াহুড়ো করে অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা গোপাল চন্দ্র দাসকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফের প্রধান শিক্ষকের চেয়ার দখল করে বসেন জালাল আহাম্মদ। সেই সঙ্গে বিদ্যালয়ের এডহক কমিটিও গঠন করেন। অথচ বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য জাহাঙ্গীর আলম আগেই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ পুনর্বহাল রাখার জন্য হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। যে মামলা বর্তমানে চলমান।
তবে এই পর্যন্ত এসেও ক্ষান্ত হননি প্রধান শিক্ষক জালাল আহম্মেদ। জাহাঙ্গীর আলম নামের এক শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে না আসায় তার পরিবর্তে রবিউল আলম নামের একজনকে খণ্ডকালিন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এমনকি তাকে বিদ্যালয় ফান্ড থেকে বেতনও দেন। অথচ ক্লাস না করেই মাসের পর মাস জাহাঙ্গীর আলম বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন।
অভিযোগ উঠেছে, খণ্ডকালীন শিক্ষক রবিউল আলমের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছেন জালাল আহাম্মদ। আরও অভিযোগ রয়েছে, প্রধান শিক্ষকের অবৈধ কাজে সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে বিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষক বিশেষ সুবিধাও পেয়ে থাকেন। যারা বিদ্যালয়ে এসেই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বাড়ির কাজ করতে চলে যান।
আবার প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী শিক্ষক কামরুন্নাহারও বিদ্যালয়ের পাঠদানের পাশাপাশি কাজ করছেন বীমা কোম্পানিতে। তাছাড়া প্রধান শিক্ষক নিজে স্থানীয় বক্সগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এমনকি নিজের নাম প্রকাশ করতে আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়টির গেটে আজিয়ারা আলহাজ্ব হাছান আলী উচ্চ বিদ্যালয় নামে গেট নির্মাণ করেছেন। তাছাড়া বিদ্যালয়কে নিজের সম্পত্তি মনে করে আসবাবপত্র বিক্রির টাকাও নিজের পকেটে ঢোকান বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রমতে, বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৫২৫ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। বিপরীতে রয়েছেন ১১ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী। পাশাপাশি প্রধান শিক্ষকের আত্মীয় পরিচয়ে রয়েছেন তিনজন খণ্ডকালিন শিক্ষক।
জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে বহিষ্কার হওয়ার পরও জালাল আহাম্মদ কীভাবে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন আবার কমিটি চলমান থাকার পরও কীভাবে এডহক কমিটি গঠন করেন সেটা বোধগম্য নয়। তিনি সত্যিই একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিদ্যোৎসাহী সদস্য আবুল হোসেন ভূঁইয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দুর্নীতির দায়ে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ক্ষমা চেয়ে প্রতিশ্রুতি করে কিছু টাকা ফেরত দেন। সভাপতি মারা যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ভয় দেখিয়ে প্রধান শিক্ষকের চেয়ার দখল করেন।
তবে সব অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জালাল আহাম্মেদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, এটা আমার স্কুল। আমি টাকা খরচ করবো না, কে করবে? দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে আপনার পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন বলে ফোন কেটে দেন।
নাঙ্গলকোট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, অভিযোগের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় হবে। জানতে চাইলে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান মেহবুব দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে আমি শিক্ষা অফিসারকে বলবো তদন্ত করে আমাকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।