শনিবার, ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ইতিহাস ঐতিহ্য--

লৌকিক আচার সিঁদুরদান

লৌকিক আচার সিঁদুরদান

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের এক মহা মিলন মেলা। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে উৎসব। দশমীর দিন বাজে বিদায়ের সুর। সেদিন হয় সিঁদুর খেলা। সিঁদুর খেলা দুর্গা পূজার এক অন্যতম অনুষ্ঠান। সিঁদুর হচ্ছে ব্রহ্মের প্রতীক। হিন্দু বিবাহিত নারীরা সিঁদুর পরেন স্বামী ও নিজের মঙ্গলের জন্য।

দশমীতে বাপের বাড়ি ছেড়ে দেবী দুর্গা ঘরে ফিরে যান। মা দুর্গার ঘরে ফেরার বিষাদ  কাটাতে আনন্দে মেতে ওঠে বাঙালী। মাকে বরণ করে সিঁদুর খেলে হাসি মুখে বিদায় জানায়। কিন্তু কেন বিদায়ের আগে মায়ের সঙ্গে সিঁদুর খেলা হয় তা অনেকেই জানে না। পুরাণ মতে, মহালয়া থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষ। বছরে একবার মাত্র দশ দিনের জন্য মা দুর্গা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন। এক বছর পর ঘরে ফিরে আসেন মা।

মেয়ের ঘরে ফেরার আনন্দে সেজে ওঠে উমার ঘর। মেয়েকে তার পচ্ছন্দের খাবার রেঁধে খাওয়ানো হয়। আবার দশমি আসতেই উমাকে তার শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সিঁদুর খেলা হল অন্যতম রীতি। বিদায়ের আগে সিঁদুর খেলা হয় কারণ, মা দুর্গাকে বাঙালিরা বিবাহিতা নারী হিসাবে মনে করেন।

হিন্দু রীতি অনুযায়ী সিঁথির সিঁদুর আসলে বিবাহিতা নারীর চিহ্ন। অনেকের বিশ্বাস, যথাযথ রীতি মেনে সিঁদুর খেলা হলে অকালে কোনও নারী বিধবা হবেন না। বিজয়া দশমীর দিন আগে মাকে বরণ করা হয়। পান পাতা, সন্দেশ-মিষ্টি ও সিঁদুর দিয়ে উমাকে বরণ করা হয়। মুখে পান পাতা ছুঁইয়ে, সন্দেশ-মিষ্টি খাইয়ে এবং সিঁদুর পরিয়ে করা হয় বরণ। এর পরপরই বিবাহিতা বাঙালি নারীরা মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। এখন অবশ্য অবিবাহিত মেয়েরাও সিদূর খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

আরও পড়ুনঃ  মেহেন্দিগঞ্জের নন্দলালের ভাগ্য বদলায়নি, অনাহারে দিনযাপন

বাংলায় মেয়েদের এ এক বিশেষ অনুষ্ঠান। দেবীকে সিঁদুর দানের পাশাপাশি একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেওয়ার রীতি। শুধু সিঁথিতেই নয়, গালে, কপালে, হাতে সর্বত্র সিঁদুর লেপে দেওয়া হয়। দুর্গাপূজার অনুসঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সিঁদুর খেলা। শুধু বিবাহিতারা নন, কুমারীরাও সিঁদুর খেলেন এখন। হিন্দু বিবাহ রীতিতে সিঁদুরদান একটি লৌকিক আচার মাত্র।

তবে প্রাচীন কাল থেকেই বিবাহিত নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁথিতে সিঁদুর পরে আসছেন। দেবী দুর্গাও বিবাহিত নারী। তাই তিনিও সিঁদুর ব্যবহার করেন। ‘ভবিষ্য পুরাণ’-এ বলা হয়েছে, সিঁদুর স্বয়ং ব্রহ্মের প্রতীক। বিবাহিত নারী সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে পরম ব্রহ্মকে আহ্বান করেন। এসবের পিছনেই রয়েছে স্বামীর মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা।

‘শ্রীমদভাগবত’-এ কাত্যায়নী ব্রত উপলক্ষ্যে গোপিনীদের সিঁদুর খেলার বিবরণও পাওয়া যায়। দেবতা পরমব্রহ্ম সংসারের সকল দুঃখ বাধা কষ্ট দূর করেন। সুখ উপহার দেন ভক্তদের। তাই তো আজকের যুগেও দশমীর দিনে সিঁদুর খেলার এত আয়োজন। মা দুর্গা পুজো পান দেবী রূপে, বিদায় নেন কন্যা রূপে। কিন্তু বিদায় বেলায় নতুন বস্ত্রে বরণ করেন দেবীকে। দেবীবরণ শেষে নিজের স্বামীর মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনায় সিঁদুর খেলা করেন বিবাহিত মেয়েরা।

পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুসারে, আশ্বিন মাসের দশমী তিথিতে উমা বাপের বাড়ি ছেড়ে কৈলাসে পাড়ি দেন। এই দিনেই মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি। পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুসারে, মা দুর্গা নয় দিন নয় রাত্রি একটানা যুদ্ধ করে দশম দিনে মহিষাসুর বধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অর্থাৎ এই দশ দিনের মাথায় বিজয় লাভ করেছিলেন তিনি। তাই দশমীকে ‘বিজয়া দশমী’ হিসেবে পালন করার প্রথা শুরু হয়। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূত হয়ে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে বিজয়লাভ করেছিলেন। বিজয়া দশমী আবার সিঁদুর খেলার বিধি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না।

আরও পড়ুনঃ  একনেকে ১০৪৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন