ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিষাক্ত পানিতে ভরছে তুরাগ

বিষাক্ত পানিতে ভরছে তুরাগ

সম্প্রতি মেঘনা নিট কম্পোজিট পরিদর্শনে গিয়ে তাদের পিএইচ বন্ধ পেয়েছি: নয়ন মিয়া, উপ-পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, গাজীপুর 

গাজীপুরের উল্লেখযোগ্য নদী, খাল ও বিলগুলোর পানি মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। এখন সেই পানিগুলো ফসলে ব্যবহারেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন কল কারখানার নির্গত দূষিত বর্জ্যে পানি ব্যবহারে অযোগ্যতা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। বিষাক্ত রাসায়নিক পানি একত্রিত হয়ে পড়ছে তুরাগে।

সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের শ্রীপুর পৌররসভার গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী এলাকায় লবলং খালে কারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলে পানি প্রবাহ বন্ধ করার বিষয় পরিদর্শন করেন। পরিবেশ দুষণ সরেজমিনে গিয়ে আশংকার কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মূল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। একসময় সারা বাংলাদেশই দিবে। বাংলাদেশের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এইখান থেকে আসে।

স্থানীয় কৃষক আফাজ উদ্দিন নূরু বলেন, এখন সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। তারপরও পানির ঝাঁঝালো গন্ধ রয়ে গেছে। কারখানার বিষাক্ত পানির সাথে প্রাকৃতিক পানি মিশে যেতেও সময় লাগে। কারখানার রাসায়নিক পানির বৈশিষ্ট্য এমন যে, বৃষ্টির পানিতে বেড়ে যাওয়া খালের পানি জমির পানির সাথে মিশে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে।

শুষ্ক মৌসুমে রাসায়নিক পানির দুর্গন্ধের তীব্রতা এলাকার বাতাসকেও দূষিত করে তোলে। আগে তিনি নিজেই চাষাবাদ করতেন। বছর দশেক তার জমি বর্গা দিয়েছেন। পানি বিষাক্ততার কাণে তিনি নিজে এখন আর চাষাবাদ করেন না। খালে নেমে যাওয়ার ভয়ে গবাদি পশুগুলো উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে পালন করতে পারেন না।

পাশের বানিয়ারচালা গ্রামের যুবক সোহাগ মিয়া বলেন, ১২ বছর আগেও লবণদহ খালের সরু সেতুর ওপর এলাকার মানুষ অবকাশ যাপন করতে যেত। খালে প্রবহমান ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে মুখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ খাল দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা ও গাজীপুরের শ্রীপুর এবং সদর উপজেলার অধিকাংশ কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য প্রবাহিত হয়।

ভবানীপুর এলাকার স্থানীয় যুবক সবুজ মিয়া বলেন, লবনদহ খালটি শ্রীপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে সদর উপজেলার বানিয়ারচালা, ভবানীপুর হয়ে মির্জাপুরে গিয়ে শালদহ নদীর সাথে মিশেছে। শালদহ নদীতে প্রবাহিত হয়ে বিষাক্ত বর্জ্য তুরাগে গিয়ে পড়ছে।

স্থানীয় গৃহিণী আমেনা খাতুন বলেন, নাকে মুখে রুমাল দিয়ে রাখতে হয়। বর্ষাকালে কালো পানি কিছুটা রং বদলায়। ঈদের সময় কারখানা বন্ধ থাকলে পানি সাদা হয়। কারখানা খোলা হলে আবার পানির রং কালো হয়। স্কুল ছাত্র শিমুল বলেন, বাইলে খেলাধুলা করতে বের হলেই ঝাঁঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম দুর্গন্ধ অব্যাহত থাকলে মানুষ বাঁচবে না।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশননের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিবেশের মূল দূষণকারী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের যে নিদারুণ অবহেলা সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গাজীপুরের যে পানি সেটা বিষাক্ত হয়ে গেছে। এই জনপদ একটা বিষাক্ত জনপদে পরিণত হয়ে গেছে। শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মূল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। একসময় সারা বাংলাদেশই দিবে। বাংলাদেশের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এইখান থেকে আসে।

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে কখনোই বলব না ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমরা শুধু এটাই বলবো যে ম্যানেজমেন্ট চেঞ্জ করে দেন। অথবা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার করতে বলব। দোষ হচ্ছে যারা এটা পরিচালনা করে ম্যানেজাররা। তাদের প্রতি আহবান জানাতে চাই আগামী প্রজন্মের কথা মনে রেখে আপনারা দুষণমুক্ত শিল্প গড়ে তোলেন।

বিশাল কারখানার সমান্য জরিমানা দিয়ে ক্ষতিপূরণ হবে না। আইন খতিয়ে দেখে যারা পরিবেশের ক্ষতি করছে তাদের জেলে নিতে হবে। লবণদহ সাগরকে নদী বানানো হয়েছে, সাগরকে বলবেন নদী, এরপর বলবেন খাল, খালকে বলবেন ড্রেন, ড্রেনকে বলবেন কাভার্ড ড্রেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশননের চেয়ারম্যান সতর্ক করে বলেন, টিটু নামে একজন খালে ময়লা ফেলার মাধ্যমে ব্যবসা করছে। আরও একজন আছে। প্রশাসনকে বলব তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনকে দুই মাস সময় দিলাম পরিবেশ দুষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যব্যস্থা নেওয়ার জন্য।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, অনেক কারখানা বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করে। আমরা অতি সম্প্রতি মেঘনা নিট কম্পোজিট কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যানটা (পিএইচ) বন্ধ পেয়েছি। তারা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) বলেছে পানির লেবেলটা বাড়লে তারা প্ল্যানটা চালু করে। এটা অনেক বেশি টেকনিক্যাল বিষয়। এখন আলোচনা করা যাবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন