বাংলার সহস্রাব্দের আবহমান সংস্কৃতির সাথে জলাঙ্গীদের প্রসঙ্গ আবশ্যিক। নদীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের একটি ক্ষেত্রকেও কল্পনা করার সুযোগ নেই। এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি সমাজ-সংস্কৃতি বা অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন গূঢ়তর, এ জনপদের সাহিত্য-চলচ্চিত্রেও ঠিক তেমনটিই।
সাহিত্য পরিক্রমায় নদ-নদী
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকেই অদ্যাবধি এমন গ্রন্থ খুব কম আছে, যেখানে নদীর উল্লেখ নেই। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য মৈমনসিংহ-গীতিকাসহ পুরোনো যতোগুলো সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায়। সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে নদীকে প্রসঙ্গ করেছে। এ ধারা আরো বেশি সচল হলো আধুনিক যুগে এসে। রবীন্দ্রনাথ একরকম নদীনির্ভরতায় ভুগেছেন। তাঁর প্রায় ষাটভাগ সাহিত্যকীর্তির রচনাস্থল নদীতীর।
পদ্মায়, যমুনায়, ইছামতীতে দাপিয়ে বেড়ানো কবির বোট বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদের স্রষ্টা। তার নায়ক-নায়িকাদের প্রায়শই পাওয়া গিয়েছে নদী তীরে, সুভা থেকে ফটিক কিংবা মৃম্ময়ী- নদী ছাড়া রবীন্দ্রনাথের একটি রচনাও কল্পনা করা দুস্তর। কাব্যসাহিত্যে নদীর ব্যবহার রীতিমতো এক বিরাট গবেষণার বস্তু। এমন কোনো কবি বোধয় নেই, যিনি নদীকে নিয়ে অন্তত পাঁচটি কবিতা লেখেননি। এ তালিকায় নজরুল-জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব থেকে -সুনীল-শামসুল হক, কেউই বাদ যাবার নয়। কবিতায় নদীর উপস্থিতি নিয়ে লিখলে তার তালিকাটি সন্দেহাতীতভাবে যথেষ্ট ভারী হয়ে উঠবে।
শুধু যে প্রভাবক, তা নয়। একটা সময় নদ-নদী হয়ে উঠতে শুরু করল রচনার কেন্দ্রবিন্দু, স্বতন্ত্র চরিত্র বা নাম-চরিত্র। এই তালিকায় পড়ে বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’, তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহানন্দা’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, সরদার জয়েনউদ্দিনের ‘পদ্মার পলি’, আসকার ইবনে শাইখের ‘বিদ্রোহী পদ্মা’র মতো শত শত রচনাসম্পদ।
ফ্রয়েডীয় ধারায় বাংলা উপন্যাসের জনক যে মানিক বন্দোপাধ্যায়, তাঁর শ্রেষ্ঠকীর্তি, তর্কযোগ্যভাবে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস সেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ও কিন্তু নদীকে ঘিরেই। আর শরৎচন্দ্রের রচনায় গ্রাম-বাংলার আবহমান নদীমাতৃকতা ও গঙ্গার উপস্থিতি, সে তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। আসলে বাংলাদেশের যাপিত জীবন এতটাই নদীকেন্দ্রিক যে, একে পাশ কাটিয়ে তার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা একেবারে অসম্ভব। নদীর প্রসঙ্গ তাই এসেই যায়। এই ব্যাপারে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বোধয় পদ্মা৷ পৃথিবীতে আর কোনো নদীকে নিয়ে এত রচনা হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই।
রূপালী পর্দায় নদীর চিত্রায়ণ
এই রীতিটি অক্ষুন্ন থেকেছে চলচ্চিত্রেও। একইভাবে বলতে হয়, এমন বাংলা সিনেমাও খুবই কম আছে, যেখানে নদীর দৃশ্যায়ন নেই। বরং অগণিত চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট চরিত্র নদীই৷ ঢালিউডের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নদীকেন্দ্রিক ছবি। উপন্যাসকে ছবিতে রূপান্তরের ধারা এরপর অব্যাহত থেকেছে। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক সিনেমায় সফলভাবে নদীকে সত্তা হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। আরেক যুগপুরুষ ঋত্বিক ঘটকের হাত থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯৭৩ সালের ‘তিতাস একটি নদীর নামে’র মতো মাস্টারপিস৷ এই ছবিটি এবং ১৯৯৩ সালে গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, দুটি চলচ্চিত্রই দর্শকজরিপ ও শিল্পগুণে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে৷ সুভাষ দত্ত,আমজাদ হোসেন,জহির রায়হান থেকে চাষী নজরুল, তারেক মাসুদ- নদীকে ক্যামেরায় টেনেছেন এঁদের প্রত্যেকেই।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রেও নদী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’,’নদীর নাম মধুমতি’ এ ধারার উল্লেখযোগ্য সংযোজন। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া'(২০০৪) ও তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা'(২০০৪) নদীকেন্দ্রিক না হলেও নদীবহুল চলচ্চিত্র। এরপরেও নদী নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে, হচ্ছে। কর্ণফুলীর কান্না (২০০৫), মনপুরা(২০০৯), মধুমতী (২০১১) থেকে অতি সাম্প্রতিক হালদা (২০১৮)- সবাই বলেছে নদীর গল্প। এই ছাড়াও সিনেমায় নদীর গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যায়ন বিবেচনা করলে, সে তালিকা হয়ে যাবে অনিঃশেষ। এককথায়, বাংলা সিনেমায় সূচনালগ্ন থেকে জলাঙ্গীদের অবস্থানটি একরকম সুনির্দিষ্ট।
সাহিত্য, চলচ্চিত্র জীবনের দর্পণ, দৃশ্যায়ন। বাংলার মানুষের জীবনের প্রতিবিম্বে নদীর অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের লেখক, নির্মাতারা পারবেন তো সেই অস্তিত্বকে প্রাপ্য মর্যাদায় অব্যাহত রাখতে? শিল্পের এই দুরন্ত খরার যুগে প্রত্যাশাটি ফিকে হলেও একেবারে নৈরাশ্যবাদী হওয়ার পক্ষপাতী আমরা নই।