ঢাকা | সোমবার
৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর্যটনে বিশ্বমানের স্বপ্ন

পর্যটনে বিশ্বমানের স্বপ্ন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক আনন্দবাজার। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পর্যটনশিল্প নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন ‘পর্যটনে বিশ্বমানের স্বপ্ন’।

বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারছে না বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পর্যটনশিল্প নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও আশানুরূপ ফল আসছে না। উল্টো দেশের পর্যটন ছেড়ে বিদেশে ভ্রমণে যাওয়ার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল অর্থাৎ ২৫ বছরে বিদেশি পর্যটক এসেছে মাত্র ৫২ লাখ। এখন টনক নড়ছে সরকারের। সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের বিশ্বে একশ কোটি পর্যটককে কাছে টানতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। সেই স্রোতে নতুন আঙ্গিকে খাতটি সাজাতে মনোযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। হাতে নিয়েছে পর্যটনশিল্পের বিকাশে মহাপরিকল্পনা।

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের অধীনস্থ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে এটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা। পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া।

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণের ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ অবস্থায় পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিবর্গ ও ভোক্তা শ্রেণীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ভ্রমণবিষয়ক সংস্থা বা আইইউওটিও। এ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজস্ব আয়ে বিশেষ অবদান রাখছে।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা নির্ধারিত ৬টি পর্যটন অঞ্চল

১৯৭০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন সংস্থার বার্ষিক সম্মেলনে এর নাম, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য পুনর্মূল্যায়ণ ও নির্ধারণ করা হয়। তখন থেকে এটি ‘বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ নামে চিহ্নিত করার বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যার কার্যক্রম নতুন নামে ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু হয়। ১৯৮০ সালের বার্ষিক সম্মেলনে ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পর্যটন দিবস পালনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে এতে একটি স্বাগতিক দেশ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের কার্যক্রমে আরো গতিশীলতা আনয়ণের পক্ষে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিংসখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এর ২০১৮-১৯ অর্থবছকে বিবেচ্য নিয়ে ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট একাউন্ট-২০২০-২১ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে উঠে আসে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক কম আসছে। ২০২১ সালে জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

জরিপ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৪১৭টি খানার সবাই দেশের মধ্যে ভ্রমণ করেছেন। তারমধ্যে একবার ভ্রমণ করেছেন এমন খানার সংখ্যা ২৫ হাজার ৮২৫টি, যা ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ। একদিন ভ্রমণকারীর সংখ্যা ৫৪৮ খানা, যা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। রাত্রিযাপনসহ ভ্রমণ করেছেন ৮ হাজার ৩৬৮ খানা, যা ২১ দশমিক ২ শতাংশ। উভয় প্রকার ভ্রমণ করেছে ১৬ হাজার ৯১০ খানা, যা ৪২দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন বহির্ভূত খানা ১৩ হাজার ৫৯১, যা ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের সম্পর্কে জরিপে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করেছেন। তাদের মধ্যে অনাবাসি বাংলাদেশি (এনআরবি) পর্যটক ১ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন (৮০ দশমিক ২৮ ভাগ)। তাদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক শূন্য দশমিক ২৯ মিলিয়ন (১৯ দশমিক ৭২ ভাগ)। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ দূরে থাক, দেশের পর্যটকদের ধরে রাখতে পারছে না পর্যটন সংস্থাগুলো।

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ৩৯ হাজার ৪১৭ হাজার খানার মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১৬৭ হাজার পর্যটক ২ দশমিক ৯৬ ভাগ খানা কমপক্ষে একবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। সেই বছর ২৯২১.৫২ হাজার বাংলাদেশি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। গড়ে প্রতিটি যাত্রায় ১ দশমিক ৮৭ জন বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। তাদের বিদেশে স্থিতিকাল ছিল ৫ দশমিক ৭৬ রাত। এসব ভ্রমণকারীদের মধ্যে ৯৪৪ দশমিক ৭৪ হাজার খানা অর্থাৎ ৬০ দশমিক ৪১ ভাগ ভারতে, ১২৭ দশমিক ০২ হাজার অর্থাৎ ৮ দশমিক ১২ ভাগ সৌদি আরবে, ৭১ দশমিক ৪৫ হাজার খানা অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫৭ ভাগ মালয়েশিয়ায়, ৩৯ দশমিক ৭০ অর্থাৎ ২ দশমিক ৫ ভাগ থাইল্যান্ডে ও অন্যান্য দেশে ৩৮১ দশমিক ০৭ অর্থাৎ ২৪ দশকি ৪ ভাগ ভ্রমণ করেছেন। মোট ভ্রমাণকারী খানার সংখ্যা ১৫৬৩ দশমিক ৯৭ হাজার বা ১০০ ভাগ। কমপক্ষে একবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ১১৬৭ খানা, যার শতকরা হার হচ্ছে ২ দশমিক ৯৬। বিদেশে ভ্রমণে প্রতিযাত্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৭৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে এবং প্রতিজনে ব্যয়ের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৬৫৪ হাজার টাকা।

জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের ৭২ শতাংশ আকাশপথ ও ২৮ শতাংশ স্থলপথ ব্যবহার করেছেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক এসেছিল বাংলাদেশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টাকা ব্যয় করেছেন বিদেশি পর্যটকরা। অনাবাসী বাংলাদেশিদের দ্বারা ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৯৮ মিলিয়ন টাকা (৮২ দশমিক ৩৮ ভাগ)। আর বিদেশি পর্যটকদের ব্যয় হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৫ মিলিয়ন টাকা (১৭ দশমিক ৬২ ভাগ)। এসব ব্যয়ের মধ্যে খাদ্য ও পানীয় বাবদ ২৩ দশমিক ৭৮ ভাগ, আবাসনে ১৮ দশমিক ৩৯ ও সড়ক যাত্রীপরিহনখাতে ১৭ দশমিক ০৪ ভাগ।

পর্যটনশিল্পের বিকাশে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটসের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এনায়েতুল্লা কৌশিক বলেন, আমাদের দেশে পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগতে হয়, যাতায়াত-খাবার-কেনাকাটায় অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এসব থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক উন্নয়ন নিতে হবে। তাছাড়া আমরা ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় স্বপ্নবাজেটে পর্যটনশিল্পের বিকাশে ২ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম ১. পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারি ঋণ/অনুদান ও স্থানীয় লোকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ২. দেশি-বিদেশিদের জন্য বাংলাদেশের পর্যটন সহজ ও নিরাপদ করতে হবে। থাকার জন্য ডাকবাংলো স্থাপন, বনাঞ্চল, অরণ্য, পাহাড়, সাগর-হাওর-নদী সর্বোপরি পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস হয় এমন কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর আইন ও নজরদারি করতে হবে। তাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি ভালো উৎস ও মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

লিংকার্স ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এন্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ বকর বলেন, বিদেশি পর্যটক না আসার কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে নিরাপত্তার অভাব। স্থানীয় লোকদের সহযোগিতা কম। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো দায়িত্ব ও কঠোর হতে হবে আইনপ্রয়োগে। কেননা নিজের জান-মালের নিরাপত্তা না থাকলে কেন পর্যটক আসবে?

বাংলার যাযাবর জাকির উসমান বলেন, দেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবন সমুদ্র সৈকত, রাঙ্গামাটির সাভলং ঝরনা, বান্দরবনের শৈলপ্রপাত ও বগা লেক এখন সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। এসব দূষণ দেখতে কি বিদেশিরা আসবে? আমাদের নিজেদের সম্পদ নিজেরা রক্ষণা-বেক্ষণসহ সম্প্রসারণ করতে পারলে বিদেশি পর্যটকে মুখরিত হবে দেশ।

বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের কোন দেশ পর্যটন কোন অবস্থানে আছে, তার র‌্যাঙ্কিং করে মুন্ডি ইনডেক্স। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম, আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। মুন্ডি র‌্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে ছয়টি স্থান পেয়েছে। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।

মুন্ডি ইনডেক্সের তথ্য মতে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে ৫২ লাখের অধিক বিদেশি পর্যটক দেশে এসেছে। আর মুন্ডির র‌্যাঙ্কিংয়ের ৩৩ নম্বরে থাকা চিলিতে শুধু ২০১৯ সালে বিদেশি পর্যটক গেছেন ৫৪ লাখের বেশি। প্রথম স্থানে থাকা ফ্রান্সে করোনার মধ্যে ২০২০ সালেও বিদেশি পর্যটক গেছে প্রায় ১২ কোটি।

মুন্ডি ইনডেক্সের তথ্য বলছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২০০৮ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ৬৭ হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। ২০০৯ সালে বিদেশি পর্যটক দুই লাখ কমে যায়। ২০১৯ সালে বিদেশি পর্যটক আসেন, ৩ লাখ ২৩ হাজার।

‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট একাউন্ট-২০২০-২১ তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনখাতের প্রত্যক্ষ স্থূল মূল্য সংযোজন (টিডিজিভিএ) ৭ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৩ মিলিয়ন টাকা যা মূল্য সংযোজন ২ কোটি ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ৯১০ মিলিয়ন টাকার ৩ দশমিক ০৮ ভাগ। পর্যটনখাতে স্থূল মূল্য সংযোজন দেশজ ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে যা জিডিপির ৩ দশমিক ০২ ভাগ। দেশে পর্যটনখাতে কর্মসংস্থান ৮ দশমিক ০৭ ভাগ। পর্যটনশিল্পের স্থূল মূল্য সংযোজন (জিভিএটিআই) ১১ দশমিক ৯৮ ভাগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন