আবু তারেক মাসুদ। যিনি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নামেই দেশ-বিদেশে পরিচিত। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুরে জন্ম নেন এই খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তারেক মাসুদ একাধারে ছিলেন একজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার। মাটির ময়না (২০০২) তাঁর প্রথম ফিচার চলচ্চিত্র যার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং এটি প্রথম বাংলাদেশি বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশকে নিবেদন করা হয়েছিল।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা নামক এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। নিহতের সে বছরই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের দাবীর মুখে ও সরকারের আশ্বাসে তারেক মাসুদের নূরপুরের গ্রামের বাড়িসহ প্রায় দেড় একর জমি সরকারের ট্রাস্টে দিলেও হয়নি কোনো স্থাপনা। অযত্নে-অবহেলা ও অনাদরে আজও পড়ে আছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ চলচ্চিত্রকর তারেক মাসুদের বাড়িটি। নিহতের প্রায় একযুগ কেটে গেলেও কোনো স্থাপনা নির্মাণ না হওয়ায় হতাশ তারেক মাসুদের পরিবারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অযত্নে বাড়িটির আঙিনায় ঘাসপাতা জন্মেছে। দর্শনার্থীদের জন্য নেই কোনো বসার বেঞ্চ কিংবা রেস্ট হাউজ। প্রতিদিন শতশত মানুষ এ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারের বাড়ি দেখতে আসছেন। কিন্তু, তাদের জন্য নেই কোনো শৌচাগার ; এতে প্রকৃতির ডাক সারাতে দর্শনার্থীরা পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। এছাড়া বাড়িটি অযত্নে-অবহেলার ছাপ চোখে পড়ে। তারেক মাসুদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সময়ে তার তোলা ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশ-বিদেশে চলচ্চিত্র ও তারেক মাসুদ ভক্তরা ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুর বাড়িতে এসে হচ্ছেন নিরাশ।
এসময় কথা হয় তারেক মাসুদের সেঁজো ভাইয়ের বউ সম্পা মাসুদের সাথে। এসময় তিনি বলেন, ২০১১ সালে তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পরে সরকারের আশ্বাসে ট্রাস্টে দেওয়া হয়েছে পুরো বাড়িটি। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতি ও অদৃশ্য কিছু কারণে তারেক মাসুদের মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও এর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় ও ভাঙ্গা গোলচত্বরের পাশে এ বাড়িটি হওয়ায় প্রতিদিনই শতশত মানুষ এখানে বাড়িটি ও তাঁর (তারেক মাসুদ) সমাধি দেখতে ভিড় জমায়। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখানে দর্শনার্থীদের জন্য একটি শৌচাগারের কিংবা বসার বেঞ্চের মতো জরুরি বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষ করেননি।
তারেক মাসুদের ভাই মাসুদ বাবু বলেন, আমরা সরকারের আশ্বাসে পুরো বাড়িটি সরকারের ট্রাস্টে লিখে দেই। সরকার এখানে তারেক মাসুদের সংগ্রহশালা, মিউজিয়াম, গবেষণাগার, লাইব্রেরী, রেস্ট হাউজ, পিকনিক কর্ণারসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন। আর এগুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিঠি পর্যন্ত এসেছিল। কিন্তু, ভাঙ্গার কিছু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অদৃশ্য কিছু কারণে তা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
সরকার কত জায়গা কত উদ্যোগ নিয়েছেন ; কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এমন একজন চলচ্চিত্রকারের বাড়ি কিংবা তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ আজও অনদরেই পড়ে আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি বিষয়টি দেখার জন্য।
তারেক মাসুদের মা নুরুন নাহার মাসুদ (৮০) বলেন, আমার তারেক মাসুদ সরকারের অনুদান ছাড়াই “মাটির ময়না” “মুক্তির গান”সহ অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সরকার ও দেশের জন্য কাজ করলেও সরকারের কোনো সুযোগ সুবিধাই কখনো নেননি। আজ তাঁর (তারেক মাসুদ) স্মৃতিগুলো নষ্ট হয়ে ও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবী আমার বাবাটার স্মৃতিটা যেন সরকার বাঁচিয়ে রাখে। আমি মরার আগে যেন এ ট্রাস্টের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারি।
এব্যাপারে তারেক মাসুদের ছোট ভাই নাহিদ মাসুদ বলেন, সরকারের আশ্বাস ও নির্দেশে আমাদের বাড়িটি ট্রাস্ট্রে লিখে দেওয়ার পরও কেন যে এখানকার কাজের কোনো অগ্রগতি নেই সেটা কষ্টদায়ক।
এব্যাপারে ভাঙ্গা জর্জ আদালতের আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ আইনজীবী ইকরাম আলী শিকদার বলেন, আসলে সবাই আমরা বিষয়টি অনুভব করি। কিন্তু সচিবালয় ও মিনিস্ট্রিতে তদবিরের অভাবে হয়তো কাজটা আগাচ্ছে না। যদি কালচার ডিপার্টমেন্ট একটু আন্তরিক হয় তাহলে কাজটি ত্বরান্বিত হতো।
এব্যাপারে তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক ও ভাঙ্গা কে,এম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোসায়েদ হোসেন ঢালী বলেন, ভাঙ্গায় তারেক মাসুদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা জরুরি। এ কমপ্লেক্সে লাইব্রেরি থাকবে, চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। তবে, এখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গদের গাফলতির কারণে এখনও আলোর মুখ দেখেনি সরকারের ট্রাস্টে দেওয়া এ বাড়িটির কোনো কাজের।
তিনি বলেন, আমরা এখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গদের এব্যাপারে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা সত্ত্বেও তারা কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারের ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই বড় কষ্টদায়ক। এছাড়া তারেক মাসুদের বাড়ির পাশে একটি ম্যুরাল তৈরির কথা এখানকার পৌরসভার মেয়রকে বলা হলেও তিনি আগ্রহ দেখাননি।
ভাঙ্গা নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সুবাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, তারেক মাসুদ ভাঙ্গার সন্তান; তবে বাংলাদেশের গর্ব। ভাঙ্গায় তারেক মাসুদের বাড়িতে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু হোক এটা আমাদের সবার চাওয়া। কিন্তু, আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলার পরও কোনো কাজের কাজ হচ্ছেনা।
ফরিদপুর তারেক মাসুদ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এইচ এম মেহেদী হাসান বলেন, এটা বড় দুঃখজনক যে আমরা এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারের স্মৃতিটুকু হারাতে বসেছি। সংরক্ষণের অভাবে তারেক মাসুদের স্মৃতিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এব্যাপারে ভাঙ্গা পৌরসভার পৌর মেয়র আবু ফয়েজ মো. রেজার মুঠোফোন একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে এব্যাপারে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিম উদ্দিন বলেন, এবছরের ১৩ আগস্টে তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশনকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা উদ্যোগ নিয়ে আর যোগাযোগ করেনি। তবে, এসংক্রান্ত ব্যাপারে অতি শীঘ্রই উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখবো।