- বিদেশে চাহিদা প্রচুর
- কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতি বছর
- আমের দেশেই নেই প্রক্রিয়াজাতের কোনো ব্যবস্থা
- উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ, বাড়েনি বাণিজ্যক্ষেত্র
চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলে (রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) আমের বাগানের পরিমান ৯০ হাজার ৮৯৪ হেক্টর। আম উৎপাদন হয়েছিল ০৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯১৩ মেট্রিকটন। ১০ বছর আগে রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১১-১২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট আমবাগান ছিল ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর। ২০১১-১২ মৌসুমে এই চার জেলায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন আম উৎপাদন হয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চলে আমের বাগান বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদন। আমের উৎপাদন বাড়লেও বাণিজ্যিক বিস্তার সেভাবে ঘটেনি। দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এতে করে বড় অঙ্কের বাণিজ্যে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আম চাষি থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি।
চলতি মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চল থেকে মাত্র ১২৩ মেট্রিকটন আম দেশের বাইরে রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসাবে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ২৫, নওগাঁ থেকে ৭৭ এবং রাজশাহী থেকে ২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে। আমের এ বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে রপ্তানির উপরে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে দিনে দিনে পানি সংকট প্রকট হয়ে উঠা। পাশাপাশি অধিক লাভের আশায় অনেকেই আম বাগান করছেন। দেখা যাচ্ছে এক যুগের ব্যবধানে রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগান এবং ফলন দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু আমের বাজার একই থেকে গেছে। রাজশাহী অঞ্চলের আম ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বিদেশে দরুন চাহিদা থাকার পরেও আম রপ্তানি করা সম্ভব হয় না। এর কারণে আম বাণিজ্য যেখানে পৌঁছানোর কথা তার বিন্দুমাত্র কাছে যেতে পারেনি।
২০১১-১২ মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৩ হাজার ২৮০, রাজশাহীতে ৮ হাজার ৯৮৬ , নওগাঁয় ৭ হাজার ৮০১ এবং নাটোরে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। ঠিক এক দশক পরে ২০২১-২২ মৌসুমে জেলাগুলোতে আম বাগানের পরিমান দাঁড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ১৬৫, নওগাঁয় ২৯ হাজার ৪৭৫, রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৬ এবং নাটোরে ৫ হাজার ৭৩৯ হেক্টরে।
দেশের বাইরের বাজারে আমের অনেক চাহিদা থাকার পরেও আম রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ প্রক্রিয়াজাতের কোন ব্যবস্থা না থাকা।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমের দেশে রপ্তানির জন্য আম প্রক্রিয়াজাতের কোন ব্যবস্থা নেই। আমকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হয়। আবার প্যাকিং হাউস অন্য জায়গায়। তারপর বিমানবন্দরে। এমন প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এতে যেমন ব্যায় বাড়ে তেমন আমও নষ্ট হয়। এসব নানান সমস্যার কারণে আম রপ্তানি করা যাচ্ছে না।
চলতি বছর ২৮ জুলাই রাজশাহীতে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি স্থানীয় আম রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে মন্ত্রী রাজশাহীতে সমন্বিত ওয়ারহাউস নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরায় এবং রাজশাহীর পবায় আলাদা প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা। এর মধ্যে রাজশাহীর পবায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি স্থাপন করবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্য মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখনও প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি। তবে এই প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে বিএমডিএ’র একটি সূত্র।
বিএমডিএর তথ্য অনুযায়ি জানান, তারা যে প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সেটি ঘণ্টায় ৩ হাজার কেজি ধরে দৈনিক প্রায় ৫০ টন আম প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। মৌসুমের প্রায় ৫ হাজার টন আম প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এখানে। যার রপ্তানিমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপরে। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে রাজশাহী বিমানবন্দর সংলগ্ন তকিপুর মৌজায় এই প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা। এ জন্য ৬০ শতক জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধা চালু হলে এখান থেকে সহজেই রপ্তানি করা যাবে আমসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য।
বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম জানান, এটি একটি সমন্বিত প্ল্যান্ট। একই সাথে এটি আধুনিক ও সয়ংক্রিয়। আম সংগ্রহের পর প্রথম ধাপে পরিপক্কতা যাচাই করা হয়। এরপর বিচ্ছিন্ন করা হবে বোটা। পরের ধাপে আকার অনুযায়ী বাছাই। এরপর ধৌতকরণ। এর পরের ধাপে গরম পানির ধারায় রোগ-জীবানুমুক্তকরণ। এরপর ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট। এই ধাপেরই কোয়ারেন্টাইন জীবানুমুক্তকরণ হবে। লেবেলিং বা মোড়ানোর পর চলে যাবে প্যাকেটজাতকরণে। প্রি-কুলিং এর পর আম যাবে অস্থায়ি গুদামে। সেখান থেকেই রপ্তানির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে আম।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন জানান, ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা আমের প্রচুর চাহিদা জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। রাজশাহীতে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হলে এসব দেশে আম রপ্তানির সুযোগ মিলবে। কৃষকরা আমের ভালো দাম পাবেন।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, অর্থনীতি পাল্টে যাবে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কারণে। বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের দিকে আগ্রহ বাড়বে চাষিদের।