ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১৫ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিনে দিনে ব্যবহার কমছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মাটির তৈরি এসব জিনিসের বদলে বাজার দখল করছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও সিরামিকসহ অন্য সব সামগ্রী। তাই আধুনিক প্রযুক্তির তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাটির তৈরি অনেক পণ্যই হারিয়ে যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো ব্যাবহৃত হচ্ছে মাটির তৈরি জিনিসপত্র। শহরবাসীর দালান-কোটা সাজাতে মাটির তৈরি নানা পট-পটারি, ফুলদানি ও বাহারি মাটির হাঁড়ির কদর রয়েছে এখনো।

জানা গেছে, গেল ২০ বছর আগেও বরিশাল জেলাজুড়ে মৃৎশিল্পের দাপট ও কদর দুটোই ছিল। তখন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় দেড় হাজারের অধিক পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করত। ওই সময় গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি এসব তৈজসপত্র সরবরাহ করা হত। কিন্তু বর্তমানে এ জেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। আগের মতো চাহিদা আর পারিশ্রমিকের ন্যায্যমূল্য না থাকায় এ পেশার লোকজন অত্যন্ত দুঃখ-দুর্দশা আর হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় অন্য পেশায় তেমন খাপ খাওয়াতে পারছেন না তারা। কম লাভ জেনেও শুধু পারিশ্রমিকের আশায় বাপ-দাদার পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো মাটি দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, মুড়ি ভাজার খোলা, কোলা, ভাটি, পিঠা তৈরির খাঁজ, জালের কাঠি, মাটির ব্যাংক ও জলকান্দা ইত্যাদি।

বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী গ্রামের কুমারপল্লীতে ঢুকলেই চোখে পড়ে তাদের কষ্টের জীবনযাত্রা। গোটা পল্লীতেই যেন লেগে আছে শত কষ্ট আর অভাবের ছোঁয়া।

সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ওই পল্লীর একাধিক বয়স্ক নারী কারিগররা তাদের নিজ হাতে মাটি দিয়ে তৈরি করে শিল্পকর্মগুলো। আবার খুব যত্ন সহকারে রোদে শুকাতেও দিচ্ছেন। আর তাদের সাহায্য করছে পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চারা। কুমার পল্লীর নমিতা রানী পালের উঠানজুড়ে রয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই, কলস, বাসন, দইয়ের বাটিসহ ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র। এই পল্লীতে প্রায় ৪০-৪৫ পরিবার কম বেশি কাজ করত। তবে ভালো আছে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। এখানে বর্তমানে মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি তৈজসপত্রের পণ্য।

এ সময় রানী পাল বলেন, আগের তুলনায় মাটির হাঁড়ি-পাতিলের চাহিদা কম। কম তৈরি করছি, বেচা বিক্রিও কম। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

স্থানীয় একাধিক কুমাররা বলেন, আগে যে মাটি এক হাজার টাকায় পাওয়া যেত বর্তমানে সেই মাটির ও জ্বালানির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। শুধু বাড়েনি কুমারদের পারিশ্রমিক। এখন আমাদের টিকে থাকার আর কোনো রাস্তা নেই। এই কাজে হাড়ভাঙা খাটুনি অথচ আয় নাম মাত্র। খরচ বাদ দিয়ে যে সামান্য আয় হয় তা দিয়ে খেয়েপড়ে বেঁচে আছি। পরবর্তী বংশধরদের জন্য যে কিছু রেখে যাব, সে ব্যবস্থাও নেই আমাদের। সন্তানেরা এখন শিক্ষিত হয়ে এ পেশা কে পরির্বতন করে জড়িয়ে যাচ্ছে অন্য পেশায়।

নবগ্রাম এলাকার সংস্কৃতিকর্মী বিশ্বজিৎ পাল জানান, বাজারে এখন মাটির তৈরি পণ্যের কোনো কদর নেই। প্লাস্টিক পণ্যের ওপর মজেছে মানুষ। ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি ক্রমশই কমে যাচ্ছে। একটা সময় মাটির তৈরি বাসন-কোসন ছাড়া বাঙালি পরিবারগুলোর দিন চলত না। মেজবান অনুষ্ঠানেও খাবার পরিবেশন হতো মাটির তৈরি বাসনে। এখন আর এমন চাহিদা না থাকায় এই মৃৎশিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাটি এলাকার রুপক পাল নামে একজন মৃৎশিল্পী ক্ষোভের সঙ্গে জানান, কুমাররা কীভাবে বেঁচে আছে, তারা কী তাদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য পায় কিনা এ খোঁজখবর রাখার কেউ নেই। কেউ জানতেও চান না আমাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা। সরকার সংশ্লিষ্টরা যদি এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে একসময় মৃৎশিল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন