সারাদেশে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত দাম বাড়লেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না। ফলে পরিবারে ও সমাজে নানা সংকট দেখা দিচ্ছে। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলান করার পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। অনেকে ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে ন্যায় অন্যায় ভুলে বসছে। অনেকেই অপরাধের পথ বেছে নিচ্ছে। এমনটা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন–
নওগাঁ প্রতিনিধি
গত বছরের তুলনায় এ বছর আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। গত তিনমাসে জেলায় প্রায় ৫৭টি চুরি সংঘঠিত হয়েছে। গত ২৫ জুন সকালে নওগাঁ শহরের শরিষাহাটির মোড় এলাকার একটি মোবাইল শোরুমে তালা ভেঙে চুরি করা হয় ১৪৫টি মোবাইল ফোন। সর্বশেষ গেলো ২১ আগস্ট বদলগাছী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর নার্স কোয়াটারে দিনের আলোয় ঘটে আরেকটি চুরির ঘটনা। একই সময়ে পাশাপাশি দু’টি বাসা থেকে সাড়ে ১৬ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ চুরি হয় কয়েক লাখ টাকার মালামাল।
শুধু চুরি নয় বেড়েছে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও। আর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে জীবনও হারাচ্ছে অনেকেই। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট নওগাঁ সদর উপজেলার আরজি নওগাঁ এলাকার অটোচালক আনোয়ার হোসেনকে হত্যা করে তার অটোরিকশা ছিনতাই করে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এসব ঘটনায় চরম আতঙ্কিত স্থানীয়রা।
এ ছাড়াও নওগাঁয় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ঋণ প্রবণতা। আর এই ঋণ প্রবণতার কারণে বেড়েছে অপমৃত্যু। জেলায় গত ৩ বছরে ঋণ প্রবণতার কারণে প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। আর ঘর ছাড়া হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার।
দুই বছর আগে মহাদেবপুর উপজেলায় এক কৃষক ঋণের দায়ে স্ত্রী-সন্তানকে দইয়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে হত্যার পর নিজেও ওই দই খেয়ে আত্মহত্যা করেন। সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট চড়া সুদ কারবারি ও এনজিও থেকে নেয়া ঋণের টাকা সময় মতো দিতে না পেরে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের পিড়াগ্রামের আদিবাসী পরিবারের এক যুবক গ্যাসবড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। শুধু আত্মহত্যায় নয় এ জেলার শত শত পরিবার আজ ঋণের জালে আবদ্ধ। ঋণের চাপ মাথায় নিয়ে কেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ গ্রাম বা শহর ছাড়া হচ্ছেন।
অপর দিকে, সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় হাত বাড়ালেয় মিলে মাদকদ্রব্য। অন্যান্য নেশার পাশাপাশি প্যান্টাডল ট্যাবলেটও এখন পাওয়া যায় হাতের নাগালেই। বর্তমানে মাদকের আগ্রাসন জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে খুব সহজেই মাদক কারবারীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তথ্য বলছে নওগাঁ অঞ্চলের অরক্ষিত সীমান্ত প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার যা তার কাটায় সুরক্ষা দেওয়া গেলে অনেকটাই মাদকের আধিপত্য কমাসহ মাদকের হাত থেকে রক্ষা পাবে মানুষ। সেই সঙ্গে কমে আসবে অপরাধ প্রবণতা। এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।
দেশে বৃহৎ একটি অংশ ছাত্রসমাজ। যাদের মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে আসে। আর এখানে এসে থাকতে হয় মেস কিংবা ভাড়া বাসায়। যদিও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু সেটি সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। ফলে তাদের মেস কিংবা ভাড়া বাসায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ফলে তারা তাদের পড়াশোনা এবং নিজ খরচ পরিচালনা করার জন্য টিউশনি কিংবা যেকোনো পার্ট টাইম জব করে থাকে।
তবে তাদের এই সীমিত আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। কারণ বর্তমান সময়ে দেশের বাজারে পণ্যের দামের যে অবস্থা তাতে জীবন যাপনে চরম শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে। বলা যায়, অনাহারে অর্ধাহারে জীবনপাত করছে। ফলে অনেকে পড়াশুনা ছেড়ে ফিরছে গ্রামে। আবার অনেকেই পা বাড়াচ্ছে বি-পথে। এতে করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ছে।
নওগাঁর সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। এরপর আবার জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি। ফলে আয় কমেছে মানুষের। যাদের আয় কমেছে তাদের প্রয়োজন মতো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমাজে প্রকটভাবে বেড়েছে বৈষম্য। নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। অনেকে এ যুদ্ধে হেরে গিয়ে নানান অপরাধে জরিয়ে পড়ছে। ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। এখন সরকারের উচিৎ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষদের সহায়তা বৃদ্ধি করে বৈষম্য দূর করা। তাহলেই অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
নওগাঁ সরকারি বিএমসি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অহিদুর রহমান বলেন, বর্তমান উর্ধমুখির এই বাজারে চাহিদার সঙ্গে আয়ের কোনো মিল নেই। ফলে মানুষের মাঝে ঋণ প্রবণতা বাড়ছে। অন্যদিকে পারিবারিক চাহিদা মেটাতে অনেকে নিজের অজান্তেই পা বাড়াচ্ছেন অপরাধ কর্মকাণ্ডে। আবার মাদকের আগ্রাসন চলছে সবখানেই। সবমিলিয়ে সমাজে বাড়ছে চুরি-ছিনতায়সহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা।
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কে এম এ মামুন খান চিশতী বলেন, হঠাৎ করে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এরকম কিছু নয়। চুরি ছিনতাইসহ অনেক ধরনের অপরাধ আছে যা সমাজে কম বেশি থাকবেই। এটি একেবারে নির্মূল করা কখনই সম্ভব নয়। তবে এই অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আমরা সব সময় জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছি।
ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি
সারাদিনের পরিশ্রম শেষে মজুরি নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা অন্য সামগ্রী কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সোনাহাটা এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ (৩০)। দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। পেশায় সিএনজি চালক। তিনি অন্যের সিএনজি ভাড়ায় চালান। তার দৈনিক আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। এ থেকে তার বিভিন্ন খরচ বাদে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থাকে। দুই মেয়ের পড়াশোনা বাড়ির খরচ শেষে তার জমানোর মতো টাকা থাকে না।
মনে দুঃখ নিয়ে ফিরোজ জানান, সকাল থেকে রাত পযন্ত সিএনজি চালিয়ে তার কষ্টে উর্পাজনের পর সব খরচা করে প্রায় খালি পকেটে ঘরে ফিরতে হয়। নিজের কোনো জমি না থাকায় চাল ডাল তেল সবই কিনতে হয় তার। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশচুম্বি দামে অনেকটা ক্ষোভ তার মনে।
ফিরোজ বলেন, প্রতিদিন গাড়ি চালানোর জন্য তাকে ৩০০ টাকার গ্যাস ভরতে হয় এছাড়া খাওয়া বাবদ খরচ হয় ১৫০ টাকা। রোড়ে প্রতি স্ট্যান্ডে দিতে হয় চাঁদা। ধুনট বাজারে ৫০ টাকা, সোনাহাটা স্ট্যান্ডে ২০ টাকা, বাগবাড়ী স্ট্যান্ডে ১০ টাকা, জালশুকা স্ট্যান্ডে ১০ টাকা, মাদলা স্ট্যান্ডে ১০ টাকা এবং বগুড়া ইয়াকুবিয়া মোড়ে ৬০ টাকা। দিন শেষে সিএনজির জন্য মালিকের কাছে জমা দিতে হয় ৩০০ টাকা। বাজার খরচ তো থাকছেই সাথে দুই মেয়ের স্কুলের খরচ।
তিনি আরো জানান, তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর মবিলসহ অনান্য পার্টসেরও দামও বেড়ে গেছে। যে মবিল ছিল ৩৮০ টাকা তা এখন ৪৫০ টাকায় কিনতে হয়। টায়ারে দাম বেড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। অনান্য ছোট পার্টসগুলোর ২০-৩০টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়। দিনের শেষে বাড়ি গিয়ে ভালো মন্দ খাওয়ার চিন্তা তো ছেড়েই দিতে হচ্ছে।
আরেক সিএনজি চালক আশরাফ আলী জানান, তিনি তার নিজস্ব গাড়ি চালান তবু তাকে হিসশিম খেতে হয়। শুধু গ্যাসের দামটা ছাড়া সবকিছুর দাম বেশি। কিন্তু ভাড়া বাড়তি করা হয়নি। কিভাবে সামনের দিনগুলোর মোকাবেলা করা হবে তা নিয়ে শংঙ্কা প্রকাশ করেন এই চালক। তিনি বলেন, নিজের কিছু জমিতে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু সার পেতে ভোগান্তির শেষ নেই। আবার জমি চাষ করতেও লেগেছে বেশি টাকা। তার মধ্যে বৃষ্টি না থাকায় সেলো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে গিয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ডিজেল। সব মিলিয়ে খাজনার চেয়ে যেন বাজনাই বেশি।