রাজধানী ঢাকার খেলার মাঠগুলোতে নেই শিশুদের প্রবেশাধিকার। অধিকাংশই রয়েছে বেদখলে। বেশ কয়েকটির প্রবেশ পথে ঝুলছে তালা। আবার বেশিরভাগের অবস্থাই শোচনীয়। অধিকাংশই উন্মুক্ত নয়। আবার শতকোটি টাকা ব্যয়ে কিছু মাঠ ও পার্ক পুনরুন্নয়নের পরও খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। যেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত সেখানে আবার খেলার উপযোগী ব্যবস্থাও নেই। এ নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই অভিভাবকদের মাঝে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ অপরিহার্য। খেলাধুলায় বেড়ে উঠতে না পারলে সেই শিশু মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে বেড়ে ওঠে। আর মাঠে খেলাধুলা করা শিশুরা মেধা ও মননে ঘরবন্দি শিশুদের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হয়ে বেড়ে ওঠে।
নগরবিদরা জানিয়েছেন, একটি আদর্শ নগরে আয়তনের ২০ থেকে ২৪ শতাংশ উন্মুক্ত মাঠ বা পার্ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে রাজধানী ঢাকার রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ জায়গা। আর একটি আদর্শ নগর কর্তৃপক্ষের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য একটি করে খেলার মাঠ থাকার কথা। অথচ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) পরিসংখ্যা বলছে, সেখানে দুই সিটির ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ৩৭টিতে কোনো খেলার মাঠ কিংবা পার্ক নেই।
অপরদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নীতিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার প্রতিটি সেক্টরে একটি করে খেলার মাঠ থাকবে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় এসব নিয়মনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি শহরের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য কমপক্ষে নয় বর্গমিটার উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন। আর এই জায়গা হওয়া উচিত পার্ক বা খেলার মাঠ। অথচ ঢাকা শহরে এই স্থানের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে এক বর্গমিটারেরও কম।
সরেজমিন, বাসাবোর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলাউদ্দিন পার্ক, খিলগাঁওয়ের জোড়পুকুর মাঠ, পুরান ঢাকার রসুলবাগ শিশুপার্ক, ধানমন্ডি মাঠ, ওসমানী উদ্যান ও পান্থকুঞ্জ পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, এসব মাঠের প্রবেশ পথে তালা ঝুলছে। আর মাঠের চারপাশে উঁচু লোহার গ্রিল দিয়ে তৈরি বেড়া রয়েছে। স্থানীয় ক্লাব, এলাকার কাউন্সিলর কিংবা প্রভাবশালীরাই মাঠগুলোর দরজা খোলা বা বন্ধ করা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর কয়েকটি উন্নয়ন কাজের নামে বছরের পর বছর বন্ধ রাখা হয়েছে। কোটি টাকা ব্যয়ে এসব মাঠের পুনরুন্নয়ন করা হলেও তাতে শিশুরা প্রবেশ করতে পারছে না।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা সামছুল ইসলাম বলেন, তিন বছর আগে মেয়র এসে জোড়পুকুর মাঠ উদ্বোধন করে গিয়েছেন। মনে করেছিলাম এবার এলাকার শিশুরা সুন্দর একটি মাঠ পেয়েছে। তারা নিয়মিত খেলতে পারবে। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকে দেখি মাঠে তারা। এলাকার কাউন্সিলর ও প্রভাশীদের ছেলেরা এসে ফুটবল খেলেন। কখনো এই মাঠে শিশুদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয় না।
বাসাবোর বাসিন্দা আকলিমা আক্তার জুঁই বলেন, বাসার পাশেই বিলাল মাঠ আছে। কিন্তু চোখ দিয়ে দেখতে পারি। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে খেলতে যেতে পারি না। মাঠ প্রায় থাকে বন্ধ। যখন খোলা হয় তখন বড়রা ফুটবল খেলে। তখন তো আর শিশুরা মাঠে নামতে পারে না।
গত এপ্রিলে কলাবাগান আবাসিক এলাকায় (পান্থপথের দক্ষিণ পাশে) তেঁতুল তলা মাঠ রক্ষায় পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত ‘যুদ্ধ’ করতে হয়েছে এলাকার সাধারণ নাগরিকদের। ওই ঘটনায় একজন শিশুকে থানা হাজতেও আটক করে রেখেছিলো পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাধ শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মাঠজুড়ে পুলিশের দেয়াল নির্মাণ বন্ধ হয়। তবে মাঠটি এখনও পুলিশের কবল থেকে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি।
এদিকে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া দেশের একমাত্র খেলার মাঠটিও বন্ধ রয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে আসাদ গেট সংলগ্ন ৪ দশমকি ১৬ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত মাঠটির বিভিন্ন স্থান এখনও উঁচু-নিচু আর ঝোঁপ-জঙ্গলে ভরে আছে। শুধু দৃশ্যমান একটি সাইনবোর্ড ছাড়া মাঠের কোথাও উন্নয়ন কাজের ছোঁয়া লাগেনি। প্রবেশপথে ঝুলছে তালা।
রাজউকের ড্যাপ ২০১৬-৩৫ এর জরিপ মতে, ঢাকা মহানগরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। তাতে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের বিপরীতে একটি দুই একরের খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দুই মেয়রও বলছেন, তারা এ নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে তারা নতুন মাঠের দিকে নজর না দিয়ে বিদ্যমান মাঠগুলোর উন্নয়ন কাজ করে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে দিচ্ছে। এতে মাঠের পরিধিও সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং জলবায়ুর অভিঘাত রুখতে উন্মুক্ত স্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরি করতে না পারলে এবং সেখানে শিশুদের খেলার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সঙ্গে সঙ্গে সব বয়সী মানুষের জন্যই দরকার পর্যাপ্ত খালি ও সবুজ স্থান।
দুই সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের আলাদা দুটি প্রকল্পের আওতায় ৪৯টি পার্ক ও খেলার মাঠের কাজ শেষ করে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, কোনো এলাকায় প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। যে মাঠের আকার হবে এক একরের। সেক্ষেত্রে সর্বশেষ জনশুমারির মতে ঢাকার এক কোটির বেশি মানুষের জন্য দুই হাজারের বেশি খেলার মাঠ দরকার। মতান্তরে রাজধানীর জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি হিসেবে ধরলে মাঠের প্রয়োজন প্রায় পাঁচ হাজার।
২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপ মতে, দুই সিটি করপোরেশন আওতাধীন এলাকায় কেবল ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে, যার মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে দখল হয়ে আছে ১৬টি মাঠ। এছাড়াও ১৭ সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টি ঈদগাহ রয়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও কমেছে বলছে সংগঠনটি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মেয়েদের জন্য কোনও খেলার মাঠ নেই। মেয়েরা মাত্র ৭ শতাংশ মাঠে খেলতে পারে।
রাজধানীতে উন্মুক্ত ২৪টি মাঠ আছে যেখানে সিটি করপোরেশনের ১৮টি মাঠ রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর সিটিতে ৬টি এবং দক্ষিণ সিটিতে আছে ১২টি মাঠ। এর মধ্যেও কিছু খেলার মাঠ আবার সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাঠের সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শহরের জনসংখ্যা ও আয়তন অনুযায়ী পার্ক ও মাঠ নেই। তবে যে কয়েকটি আছে সেগুলোকে আমরা আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে আমরা একটা করে খেলার মাঠ-পার্ক করতে চাই। এজন্য প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হবে’।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘কোনও মাঠে যদি শিশুদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয় বা প্রতিবন্ধকতা থাকে আমরা ব্যবস্থা নিবো। এছাড়া আমরা ৩০ বছর মেয়াদী একটি ‘ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি। এর আওতায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করবো’।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘এটা সত্য যে আমাদের ঢাকায় পর্যাপ্ত মাঠ ও পার্ক নেই। যে কয়টি রয়েছে সেগুলোতেও শিশুদের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। আবার কিছু কিছু মাঠ বড় বড় ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেগুলোতে তারা ছাড়া এলাকার সাধারণ মানুষ ও শিশুরা প্রবেশ করতে পারে না। আবার অধিকাংশ পার্ক উন্নয়নের নামে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। শহরের অন্যতম শহবাগের শিশু পার্কটিও কয়েক বছর ধরে বন্ধ। যে কারণে শিশুরা খেলার অধিকার হারাচ্ছে’।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সচিব ইকবাল হাবিব বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ঢাকার মাঠের সংখ্যা বাড়েনি বরং উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যেসব খেলার মাঠ এখনও আছে, সেসবের অধিকাংশও বেদখল হয়ে গেছে’।
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছরে যেসব মাঠ ও পার্কের উন্নয়ন করা হয়েছে সেগুলো ব্যবহারে গাইড লাইন তৈরি না করায় সমানভাবে শিশুরা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের উচিত একটি কার্যকরী কমিটি করে মাঠ ও পার্কগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া‘। যেকোনো উন্নয়ন কাজে শিশুদের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লেখক: অতিথি প্রতিবেদক