ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জরুরি টিকিটে শঙ্কা

জরুরি-টিকিটে-শঙ্কা

বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের প্রতীক সাদা বলাকা। এই বলাকাই আকাশে ডানা মেলে উড়ছে বিশ্বের প্রায় ১৬টি দেশে। চুক্তি আছে ৭০টি দেশের সঙ্গে। ভারত থেকে নিয়ে আসা ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি-৩ দিয়ে শুরু বাংলাদেশের বিমানের। তারপর থেকে পর্যায়ক্রমে এগিয়েছে বিমান। পরিচালিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উভয় মালিকানায়। তবে বেসরকারি বিমানে ঢাকা-কলকাতা ও ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রুটে বাংলাদেশ বিমানের আসন ফাঁকা থাকলেও বেসরকারি বা বিদেশি বিমানগুলোর আসন তেমন ফাঁকা থাকে না। এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজবাংলা২৪ডটকমের বিশেষ প্রতিবেদক রহমান মাসুদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষে ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি যান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া তার পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দিল্লি যাচ্ছি। বাংলাদেশ বিমানে। ক্যাপটেন জাহিদ ও তার দলের সঙ্গে। বোয়িং ৭৩৭। সুপরিসর, নতুন ও আধুনিক এয়ারক্রাফট। বিমান ছাড়তে আর ১০ মিনিট বাকি। কিন্তু বেশিরভাগ সিটই খালি। কারণ সকাল থেকে অন্যান্য এয়ারলাইনসের তিনটি ফ্লাইট দিল্লি চলে গেছে। হয়তো আরও কিছু যাত্রি উঠবে। কিন্তু অর্ধেক সিটই হয়তো খালি থাকবে। অথচ যাত্রিভারে টালমাটাল চেন্নাই রুটে বিমান ফ্লাইট দেয় না। আহমেদাবাদও জনপ্রিয় রুট। মালদ্বীপ বা কলম্বোর কথা নাই বললাম। মন খারাপের আরও একটা কারণ, অভিযানের ভয়ে বিমানবন্দরের কোনো ব্যাংক বুথে ডলার, ইউরো, রুপি নেই। যা বিশ্বের কোনো বিমানবন্দরে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। মানুষগুলো এখানে এসে অসহায় হয়ে পড়ছে…।

সেই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে গতকাল রবিবার রহমান মাসুদের সঙ্গে দৈনিক আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। ঢাকা-নয়াদিল্লিতে যাতায়াতে বিমানভাড়ার বিষয়ে মাসুদ জানান, বিমানে ভাড়ার ব্যাপারে একেক সময় একেক ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক মাস আগে টিকেট কিনলে হয়তো দেখা যায়, ১৫ হাজার টাকার টিকেট ১৫ হাজার টাকাতেই পাওয়া যায়। আবার এটি এক সপ্তাহ আগে কিনতে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। এমনকি একদিন বা সেইদিন কিনতে গেলে দেখা যায় ৭০-৭৫ হাজার টাকা দিয়েও টিকেট পাওয়া যায় না।

রহমান মাসুদ আরও বলেন, এখানে স্লটভিত্তিক টিকেট বিক্রি হয় অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ১০টি, পরে আবার ১০টি এভাবে বিক্রি হয়। তাতে দেখা যায়, যারা প্রথমদিকে টিকেট কিনতে পারেন সেক্ষেত্রে টাকা অনেক কম লাগে। আর শেষের দিকে যারা টিকেট কেনেন তাদের প্রচুর ব্যয় করতে হয়।
রহমান মাসুদ আসন ফাঁকা থাকার বিষয়ে বলেন, আমার কাছে মনে হয় ১২টা ২০ মিনিটে যখন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট হয়, তার আগে ৩টি ফ্লাইট ঢাকা ছাড়ে। এরমধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বেসরকারি ফ্লাইট রয়েছে। এতে করে যাত্রীরা সেসব ফ্লাইটে চলে যায়। কেননা সকাল সকাল গেলে সারাদিন কাজ করা সম্ভব হয়। অপরদিকে দুপুরে গেলে সেদিনটিতে আর কোনো কর্মঘণ্টা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে এ সময়কার ১৯০ আসনের এয়ারবাসে ৩০ থেকে ৩৪ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকে।

বাংলাদেশ বিমান এয়ার লাইন্স লিমিটেডের দেয়া প্রক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রুটে প্রতিদিন একটি ও সপ্তাহে ৭টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। আর ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট তথা প্রতিদিন ২টি করে ফ্লাইট পরিচালিত হয়ে থাকে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রুটে ৩৪২টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে। তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৩৭০ জন। একই সময়ে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে ৬২০টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৭১২ জন।

গত তিন বছরে ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রুটে মোট ৮১০টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে। তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ৫৪৯ জন। তার মধ্যে ২০১৯-২০২০ সালে ৩৩০টি ফ্লাইটে যাত্রী ছিল ২৯ হাজার ৯৯০ জন। ২০২০-২০২১ সালে ১০০টি ফ্লাইটে ৩ হাজার ৬০৮ জন ও ২০২১-২০২২ সালে ৩৮০টি ফ্লাইটে ৪৭ হাজার ৯৫১ জন যাত্রী ছিল। একই সময়ে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে মোট ১৬১৬টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ২০৫ জন। তাতে ২০১৯-২০২০ সালে ১০৫০টি ফ্লাইটে ৮৯ হাজার ৯৮১ জন যাত্রী ছিল। ২০২০-২০২১ সালে ৮৪টি ফ্লাইটে ৩ হাজার ৩৪২ জন যাত্রী ও ২০২১-২০২২ সালে ৪৮২টি ফ্লাইটে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৮৮২ জন।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বিমান সংস্থাটি ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই সর্বপ্রথম দুইটি উড়োজাহাজ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইউএস-বাংলা গ্রুপের একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সাল থেকে ভারতে ও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গণচীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, শ্রীলাঙ্কাসহ কয়েকটি রুটে নিয়মিত ফ্লাইট চালনা করছে।

ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা-চেন্নাই-ঢাকা, চট্টগ্রাম-চেন্নাই-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে শিডিউল ফ্লাইট পরিচালনা করছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকি। এসব ফ্লাইটে ১৬০, ১৩০, ৭২, ৭৬টি আসনের বিমান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফ্লাইটগুলোতে প্রতিনিয়ত যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন ৪টি ফ্লাইট তথা মাসে ১২০ ও বছরে ১৪০০টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।

কামরুল ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার্থী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা আমাদের ফ্লাইট পছন্দ করেন। ফ্লাইটগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে জেট ফুয়েলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। আগের তুলনায় মুনাফা কম হয় তবে লোকসানে পড়িনি।

সম্প্রতি ভারত থেকে ঘুরে এসেছেন দৈনিক ভোরের কাগজের সিনিয়র সাংবাদিক ও ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-ডুরার সভাপতি মো. রুহুল আমীন। তিনি বলেন, আমি ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে ভারত সফর করে এসেছি। কাগজপত্র সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা দু’দেশের কোনো বিমানবন্দরেই হয়নি।

গত আগস্ট মাসে ভারতে গিয়েছিলেন শোয়েব আহমেদ রিশাদ নামের এক ব্যক্তি। তাকে প্রশ্ন করা হলে জানান, তিনি ইউএস বাংলার বিমানে ভারত সফর করেছেন। এখানেও টিকেটের দামে হেরফের হয়ে থাকে। আগে কিনলে কম দাম ও পরে কিনলে বেশি টাকা দিতে হয়। তিনি জানান, ভারতে যাওয়ার পথে তাকে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা ও আসার পথে ১১ হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে টিকেট কিনলে ১০ হাজার টিকেট ২০ হাজার টাকা দিতে হয়।

রিশাদ জানান, ভারতে গেলে টিকা নেয়ার সনদ দেখাতে হয়। এটি না নিলে ঝামেলায় পড়তে হয়। তা ছাড়া আসার সময় সেই দেশ থেকে আরেকটি স্বাস্থ্যগত সনদপত্র দেয়া হয়। এটি বাংলাদেশিরা বেশি একটা আনতে চায় না। এটি না থাকলে বিমানবন্দরে সমস্যায় পড়তে হয়।

এভিয়েশন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে ‘নভোএয়ার’ যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু করে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে বিমান সংস্থাটি অভ্যন্তরীণ বাজারে শক্ত অবস্থানে আছে এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিস্তার লাভের পরিকল্পনা করছে।

নভোএয়ারের মার্কেটিং এন্ড সেলস ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান মেসবা-উল-হাসান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, তারা প্রতিদিন একটি করে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকেন। ৭২ আসনের বাসে কখনো যাত্রী সংকটও হয়ে থাকে। এই রুটে বছরে ৩৬০ হতে ৩৬৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। যাতায়াত মিলে প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নেয়া হয়। তবে কখনো এটি বাড়ে ও কমে।

এয়ার-ইন্ডিয়ার ঢাকাস্থ অফিসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর দিদারুল আলমকে দৈনিক আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, সপ্তাহে এয়ার-ইন্ডিয়ার ৩টি ফ্লাইট ঢাকা-কলকাতা-ঢাকায় পরিচালিত হয়। ১৫০ আসনের এসব এয়ারবাসে সিট সাধারণত ফাঁকা থাকে না। দিদারুল আলম আরও জানান, এই রুটে তারা ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে থাকেন।

এয়ার-ইন্ডিয়া ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে মালিকানা পাল্টে টাটা গ্রুপের কাছে এসেছে। তারা নতুন করে দুই আড়াই মাস আগে কাজ শুরু করেছেন। এ জন্য তাদের কাছে আগের কোনো তথ্য নেই। তার হিসেবে মাসে ১২টি ফ্লাইট পরিচালিত হয়।

দিদারুল আলমকে ৭২ ঘণ্টা আগে টিকেট ফেরত দিলে এয়ার-ইন্ডিয়া লিমিটেড কত শতাংশ টাকা কেটে রাখে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিমানের টিকেটের ক্ষেত্রে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট বিক্রি হয়। এটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন-আএটিএ এর নিয়মে চলে থাকে। এটি বাংলাদেশ বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি বদ্ধ। তাদের নিয়মেই বিশ্বের বিমান সংস্থাগুলোর টিকেট সিস্টেম পরিচালিত হয়। এখানে আমাদের হাতে কিছু করার নেই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন