বগুড়ার নন্দীগ্রাম থেকে নীলফারীর সৈয়দপুর পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটার রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক। এ সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ২৭টি স্পটকে বলা হয়ে থাকে ‘ ডেথস্পট’। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ স্পটগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৮৩ জন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। নিহত-আহতের পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার সম্পদ।
সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার খারুভাজ ব্রিজের কাছে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৭০ জন। এর আগে গত ৪ মে রংপুরের পাগলাপীর সলেয়াশা বাজারে সন্ধায় সাতটায় ( মহাসড়কে) থ্রি হুইলাম ও একটি হাইএক্স বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হয়। ওই ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত আরো ৬ জন। এ স্থান দুটি ডেথস্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর আগে গত বছরের ২৭শে নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তারাগঞ্জ কোল্ডস্টোরের সামনে একটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সঙ্গে বাসের মুখিমুখি সংঘর্ষ হয়, তাতে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত হয়।
হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট থেকে রংপুরের দমদমা ব্রিজ পর্যন্ত রয়েছে ৮টি ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে। এরমধ্যে পীরগঞ্জের আঙরার ব্রীজ, মাদারহাট, পীরগঞ্জের লালদিঘি, মিঠাপুকরের জায়গীরহাট ও দমদমাব্রীজ অন্যতম।
অন্যদিকে, দমদমা ব্রীজ থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত দশটি ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে। এরমধ্যে তারাগঞ্জের বেলতলি, তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে, সলেয়াশা বাজার, সামিট ফুড কোম্পানি সংলগ্ন, হাজিরহাট আকিজ বিড়ি মোড়, সৈয়দপুরের কামারপকুর ও সৈয়দপুর বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজার এলাাকা অন্যতম। এছাড়া বগুড়ার নন্দীগ্রাম থেকে মোকামতলা পর্যন্ত আরো ৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এতসবের মধ্যেও মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার যান। বিশেষ করে এসব বাহনের চালকরা হচ্ছে কিশোর ও অদক্ষ। সড়কের এক পাশে বাস বা অন্য পরিবহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার চেষ্টা করে চালকরা।
হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ও শ্রমিক নেতারা জানিয়েছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা হচ্ছে তার বড় কারণই হচ্ছে তিন চাকার যান। এসব যান-বাহনে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই পরিপক্ক চালক। সেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা, সিগনাল না বোঝা এবং হুটহাট করে মোচড় (পাশ কাটা) নিতেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে।
রংপুর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সুত্রে জানায়, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর নীলফামারী সৈয়দপুরে ট্রাকচাপায় তিনজন নিহত হয়েছেন। সৈয়দপুর বাস টার্মিনাল এলাকার কাছে এ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা সবাই শ্রমিক ছিলেন। গেল বছর ২৩ জুলাই বগুড়ার নন্দীগ্রামের জামতলায় ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হয় । আহত হয় অন্তত ৪৫ জন। গত বছরের ৪ নভেম্বর নীলফামারীর সৈয়দপুরের দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়কের রাবেয়া বাস স্ট্যান্ডসংলগ্ন এলাকায় বাসের ধাক্কায় ভ্যানচালক ও এক যাত্রীর নিহত হন।
এরপর ২৫ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সৈয়দপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের কলাবাগান এলাকায় বাস চাপায় নির্বাচন কর্মকর্তা নিহত হন। ৯ ফেব্রুয়ারি নীলফামারীর সৈয়দপুরে কাভার্ড ভ্যান চাপায় এক যাত্রী মারা যান।
গত ২৪ এপ্রিল তারাগঞ্জে ব্যাটারী চালিত একটি অটো রিক্সার ৬ যাত্রীকে বাঁচাতে দুই বাসের মুখিমুখিসংঘর্ষ হয়, এতে ২ জন নিহত হয়। রংপুর থেকে সৈয়দপুরগামী নুরানী ট্রাভেলস বাসের ছয়জন যাত্রী আহত হয়। গত ২৭ এপ্রিল সাদুল্লাপুরের মহেশপুর নামক স্থানে বাস ও অটোরিকশার সংঘর্ষে তিন যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় আরো ৪ জন। গত ১৮ মার্চ রংপুরের মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি বড়দরগা এলাকায় বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়। এ সময় আহত হয় আরও পাঁচজন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের ইকরচালী পাকারপুল নামক স্থানে বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ২২ জন। আহতদের উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি মিঠাপুকুরে বাস ও সিমেন্ট ভর্ভি কার্গো ট্রাকের মুখোমুখি সংঘের্ষ দুইজন নিহত হয়। এই দুর্ঘটনার কারণও অটোরিকশার যাত্রীকে বাঁচাতে।
মহাসড়কে অটোরিকশা চালান তারাগঞ্জের শলেয়াশাবাজার এলাকার রহমত আলী। তিনি বলেন, রাস্তার একপাশ দিয়ে অটোচালাই কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কিছু সময় বড় বড় বাস ও ট্রাক যখন যায় তখন একটু সচেতন থাকতে হয়। পুলিশ মামলা দেয় কী না জানতে চাইলে বলেন, আমাকে কখনো মামলা দেয়নি। মহাসড়কের পাগলাপীর এলাকায় কথা হয় থ্রি হুইলার চালক মনির হোসেন বলেন, আমি সৈয়দপুর থেকে রংপুরের মেডিক্যাল মোড় পর্যন্ত যাত্রী আনা নেয়া করি। কোনো সমস্যা হয় না। আমাকে কখনো কেউ মামলা দেয় নাই।
বড়দরগাহাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান আলী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমার এড়িয়াতে পীরগঞ্জের আঙ্গার ব্রিজ এলাকাসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। আমরা এসব এলাকায় নিয়মিত পুলিশ বসিয়ে রাখি। যাতে করে তিন চাকার যান মহাসড়কে চলতে না পারে। আমরা নিয়মিত মামলা দিচ্ছি। যে কারণে এ এলাকাগুলোতে তিন চাকার যান চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে।
তারাগগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মাহবুব মোরশেদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, মামলা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম। সড়ক দুর্ঘটনা হলে কেউ মামলা করতে চায় না। পুলিশই বাদী হয়ে মামলা করতে হয়। আমরা সেটা অব্যাহত রেখেছি। মহাসড়কে ছোটযানবাহন চলাচল অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আইন প্রয়োগ আমরা করছি কিন্তু মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের (রংপুর জোন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া মহাসড়কের আবারো তিন চাকার যান চলাচল বেড়ে গেছে। এর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এ বছরে আমরা ৩০টি দুর্ঘটনাজনিত মামলা করেছি। এছাড়াও প্রতিনিয়তই তিন চাকার যান-বাহনের মামলা দিচ্ছি। সড়কে সদর্ক রয়েছে পুলিশ। মহাসড়কের চিহ্নিত দুর্ঘটনাকবলিত স্থানগুলোয় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডগান নিয়ে অভিযান চালানো হয় প্রায়ই। হাইওয়ে পুলিশের খাতায় মহাসড়কে দুর্ঘটনাকবলিত নির্দিষ্ট স্থান (ঝুঁকিপূর্ণ) থাকলেও তা মানতে নারাজ রংপুর সড়ক বিভাগ।
রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বগুড়ার থেকে রংপুর মডার্ণ মোড় হয়ে সৈয়দপুরের উপর দিয়ে পঞ্চগড়েরর তেতুলিয়া পর্যন্ত যে মহাসড়ক রয়েছে তাতে দুর্ঘটনাকবলি ঝুঁকিপূর্ণ নেই। সামান্য যা রয়েছে সেখানে সতর্কমূলক সাইন বোর্ড দেয়া আছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন রংপুর বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ বলেন, মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন, ভটভটি, নসিমন করিমন বন্ধের দাবিতে আমরা বহুবার, অসংখ্যবার বলেছি, আন্দোলনে গিয়েছি, কিছুই হয়নি। আপনারা সড়কে গেলেই দেখতে পাবেন ঘটনায় যতটা বাস চলে তার চেয়ে বেশী চলে অটোরিকশা, থ্রি হুইলার। এসব কীভাবে চলে আমরা সেটা সবাই জানি। তিনি বলেন, সড়কে তিন চাকার যান চলা বন্ধ হলেই দুর্ঘটনা প্রায় শুণ্যের কোটায় চলে আসবে। আমরা আশা করবো কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে নজর দিবেন।
নিরাপদ সড়ক চাই রংপুর বিভাগের সমন্বয়ক সাজ্জাদ হায়দার আনন্দবাজার কে বলেন, গত এক বছরে এ বিভাগের ৮ জেলায় ৩৩৯টি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪৮৩ জন মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। তিনি বলেন, অদক্ষ চালক আর মানুষের অসচেতনতাই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।
আনন্দবাজার/শহক