ঢাকা | মঙ্গলবার
১৮ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৪ঠা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আত্মহত্যায় প্ররোচনায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা

আত্মহত্যায় প্ররোচনায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা

ইঁদুর মারার বিষে কিশোরীর মৃত্যু

৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রভা স্কুল ড্রেসের সঙ্গে ট্রাউজার পরে ক্লাসে আসে। বিষয়টি নিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক নার্গিস সুলতানা কণিকার। এ নিয়ে শিক্ষিকা নার্গিস প্রভাকে শ্রেণিক্ষে দাঁড় করিয়ে অপমান করেন। একপর্যায়ে তাকে বেত দিয়ে আঘাত করেন এবং থাপ্পড় দেন। শিক্ষকের এমন আচরণ মানতে না পেরে প্রভা শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে ইঁদুর মারার বিষ কিনে খেয়ে থানায় চলে যায়

এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না। শুধু শুধু কারো বিরুদ্ধে দোষ দিয়ে লাভ কি। আমি চাই বিষয়টা আর না এগুক: কিশোরীর মা

মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে শিক্ষিকা

নরসিংদীর শিবপুরে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে কিশোরীর মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষক নার্গিস সুলতানা কণিকার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। মৃত্যুর আগে শিবপুর থানায় গিয়ে কিশোরীর দেওয়া বক্তব্য এজাহারে উল্লেখ করলে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপপরিদর্শক আফজাল মিয়া বাদি হয়ে মামলাটি করেন।

গত বৃহস্পতিবার শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বেত্রাঘাত ও অপমান সইতে না পেরে ওই কিশোরী বিষ খেয়ে নিজেই থানায় চলে গিয়েছিল। সেখানেই ঢলে পড়লে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মারা যাওয়া প্রভা আক্তার (১৩) শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের জয়মঙ্গল গ্রামের প্রবাসী ভুট্টো মিয়ার মেয়ে। সে শিবপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

গত শুক্রবার দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কিশোরীর মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর মরদেহ পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিতে নিহত কিশোরীর মা ও চাচাসহ পরিবারের সদস্যরা মর্গের সামনে খোলা মাঠে অপেক্ষা করছেন। দুপুর ২টার পর মরদেহ হস্তান্তর করার পর তারা দাফনের জন্য তার মরদেহ এলাকায় নিয়ে যান। পরে বিকেলে জানাজার পর তার মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই ছিল দুরন্ত প্রকৃতির, কারো কথা শুনতে চাইতো না। মাস পাঁচেক আগে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আরও একবার ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে নিয়েছিল। সেবার চিকিৎসকদের চেষ্টায় কোনোরকমে বেঁচে যাওয়ার পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। নিজের যা ইচ্ছে হত, তাই করত। কারো সঙ্গে ঝগড়া লাগলে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কাটত। পরিবারে একমাত্র বাবাকেই ভয় পেত, সেই বাবাও ছয়মাস ধরে প্রবাসে। তার এসব কর্মকাণ্ডে ঘরের সবাই অতিষ্ট ছিলেন।

নিহত কিশোরীর মা জানান, আমরা এ ঘটনায় কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না। শুধু শুধু কারো বিরুদ্ধে দোষ দিয়ে লাভ কি। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধেও আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা থানা-পুলিশকেও এমনটা জানিয়েছি। মা হিসেবে মেয়েকে তো আমি চিনি, তাই বিষয়টা আর না এগুক, তাই চাই।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রভার সহপাঠিদের ভাষ্য, প্রভা বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাকের সঙ্গে ট্রাউজার পরে এসেছিল। বেলা তিনটার দিকে অষ্টম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে পড়াতে আসেন সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক নার্গিস সুলতানা ওরফে কণিকা। এ সময় প্রভার ট্রাউজার পরে আসার বিষয়টি তাঁর নজরে আসে। তিনি প্রভাকে শ্রেণিক্ষে দাঁড় করিয়ে অপমান করেন। একপর্যায়ে তাকে বেত দিয়ে কয়েকটি আঘাত করেন এবং থাপ্পড় দেন। শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিক্ষকের এমন আচরণ মানতে পারেনি প্রভা। ওই সময়ই শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে বিদ্যালয়ের বাইরে চলে যায় সে।

বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে প্রভা শিবপুর বাজারের একটি দোকান থেকে ইঁদুর মারার বিষ কেনে। পরে এটি খেয়ে শিবপুর থানার ডিউটি অফিসার এইচ আই জিয়ার কাছে চলে আসে। এ সময় প্রভা জানায়, ‘ক্লাসে কণিকা ম্যাডাম মেরেছে, তাই ইঁদুর মারার ওষুধ কিনে খেয়েছি।’ এরপরই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে থানা থেকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হলে প্রধান শিক্ষক নূর উদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীরসহ একদল শিক্ষক তাকে থানা থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।

পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। খবর পেয়ে প্রভার মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা হাসপাতালে আসেন। অনেকটা সময় চেষ্টার পরও অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর উদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কী এমন ঘটেছিল যে ছাত্রী শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলল, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদে পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সবসময়ই শিক্ষকদের বলি, শিক্ষার্থীদের মারধর করার দরকার নেই। বেশি সমস্যা হলে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ডেকে টিসি দিয়ে দেব। তবে, তাদের গায়ে হাত দেওয়ার দরকার নেই। তবু কেউ কেউ আছেন, এ নির্দেশ মানতে চান না।

শিক্ষক নার্গিস সুলতানার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার  মুঠোফোনও বন্ধ। তাকে আটকের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার বাড়ির প্রতিবেশীরা জানান, বর্তমানে তিনি গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন। এসব কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, মারা যাওয়া কিশোরীর মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ছাত্রী মৃত্যুর আগে থানায় এসে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা একটা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রেখেছিলাম। এ ঘটনায় কিশোরীর বক্তব্য এজাহারে উল্লেখ করে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন