ঢাকা | বুধবার
২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মজুরি বঞ্চনায় শ্রমিকরা

মজুরি বঞ্চনায় শ্রমিকরা

চা শ্রমিকের চেয়েও কম মজুরি অন্যখাতে

  • দেশে মোট শ্রমিক ৬ কোটি ৩৫ লাখ

সম্প্রতি দেশে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর তাদের পাওয়া নিম্ন মজুরির বিষয়টি সকলের সামনে এসেছে। পরবর্তীতে সরকারের হস্তক্ষেপে দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র চা শ্রমিকরাই নয়, এরকম যৎসামান্য মজুরি পাচ্ছেন দেশের আরও বহু খাতের শ্রমিক।

বিভিন্ন পেশা খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সরকারের একটি বিশেষ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ড নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়ার কথা। তবে কোন কোন খাতের মজুরি গত কয়েক বছরে পুনঃনির্ধারণ করা হলেও অনেকগুলো খাতের মজুরির কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার সরকার নির্ধারিত মজুরির কম দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে কোন কোন খাতে। একমাত্র তৈরি পোশাকের মতো খাতে কিছুটা নিয়মিতভাবে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অন্যসব খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। এই আইনে বলা আছে, কীভাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন হবে, কীভাবে কাজ করবে, কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে এবং কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে। তবে কোন পেশার মজুরীর ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরি বোর্ড নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারে না।

এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর পর এই মজুরি বোর্ড কাজ শুরু করে এবং তাদের পর্যালোচনা শেষে সুপারিশ প্রদান করে। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচবছর পর পর নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। ফলে কোন কোন খাতে যেমন ৫ বছর পরে পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়, কোন কোন খাতে ৩ বছর পরে হয়ে থাকে, আবার কোন কোন খাতে দীর্ঘসময় ধরে কোন পর্যালোচনা হয় না।

সাধারণত শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা এবং দ্রব্যের মূল্য, মূল্যস্ফীতি এগুলোর সঙ্গে কাজের ধরণ অর্থাৎ সেই কাজে ঝুঁকি কতটা আছে এবং মালিক পক্ষের কতটা সামর্থ্য আছে, সেগুলোও বিবেচনায় নিয়ে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কোন কোন খাতের মজুরি মাত্র ৩ হাজার টাকা, আবার কোন কোন খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি। যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। যার মধ্যে বেসিক হবে ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা এবং অন্যান্য ১ হাজার ৮৫০ টাকা। বিদেশি ক্রেতাদের চাপ, সরকারি নজরদারি ও শক্তিশালী শ্রম সংগঠন থাকায় এই খাতে মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

আন্দোলনের মুখে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি পুনমূল্যায়ন করা হলেও অনেক খাত উপেক্ষিত থেকে গেছে। এর বাইরে রাবার শিল্প, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচ শিল্প, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রোল পাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি. ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণ শিল্প, ইত্যাদি খাতের মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছিল বহু বছর আগে। যেমন কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাচ শিল্পের ২০১৩ সালে আর বিড়ি শিল্পের ২০১৬ সালে। আবার পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি বহু বছর আগে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে এই খাতে এখন শ্রমিকরা আট থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসে আয় করেন।

শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরির তথ্য অনুসারে , সিনেমা হল শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৩ অনুযায়ী মূল বেতন ১ হাজার ৪৫০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ২ হাজার ৬১০ টাকা, ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল  শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১২ অনুযায়ী মূল বেতন ১ হাজার ৮৫০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি  ৩ হাজার টাকা, রাবার শিল্প শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৩ অনুযায়ী মূল বেতন ৩ হাজার টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৪ হাজার ৯৫০ টাকা, হোটেল ও রেস্তোরা শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৭ অনুযায়ী মূল বেতন ২ হাজার ১৫০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৩ হাজার ৭১০ টাকা, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারী শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৮ অনুযায়ী মূল বেতন ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৫ হাজার ৯৪০ টাকা, দর্জি কারখানা শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৮ অনুযায়ী মূল বেতন ৩ হাজার টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৪ হাজার ৮৫০ টাকা, ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১০ অনুযায়ী মূল বেতন ৪ হাজার ৮০০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৭ হাজার ৪২০ টাকা, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানা শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০২০ অনুযায়ী মূল বেতন ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৭ হাজার ১০০ টাকা, হোমিওপ্যাথ কারখানা শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১১ অনুযায়ী মূল বেতন ২ হাজার ৯৩৪ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৫ হাজার ২০১ টাকা , কটন টেক্সটাইল শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ২০১৮ অনুযায়ী মূল বেতন ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং নিম্নতম মোট মজুরি ৫ হাজার ৭১০ টাকা।

একদিকে, এই যৎসামান্য মজুরি অন্যদিকে বর্তমান বাজারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জীবনের চড়া দাম, মূল্যস্ফীতির চাপে এই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন