সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষা মহারশি নদী এখন ঝিনাইগাতীর দুঃখ হিসেবে পরিগনিত। দীর্ঘদিন ধরে মহারশি নদীর দুই পাড়ের মাটির বাঁধ সংস্কার না করায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ঘরবাড়ি ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ অবস্থায় মহারশি নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইগাতী সীমান্তের ওপারেই ভারতের পাহাড়বেষ্টিত রাজ্য মেঘালয়। ভারতসীমান্ত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঝিনাইগাতী উপজেলার মধ্য দিয়ে মহারশি নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ১৭ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৫৭ মিটার। মেঘালয়ে বৃষ্টি হলে পানি দ্রুত বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রবাহিত হয়ে থাকে। এ সময় পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল তোড়ে মহারশি নদীর দুই পাড়ের মাটির বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গিয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলা পরিষদ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সদর বাজারসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। সেইসঙ্গে অতি অল্প সময়ে ঢলের পানিতে উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নের গ্রামীণ জনপদ প্লাবিত হয়।
গত ৯ ও ১৭ জুন ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মহারশি নদীর বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যায়। এতে ঢলের পানি নদীর দুই পাড় উপচে দ্রুতগতিতে ঝিনাইগাতী সদর বাজার ও উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে এবং উপজেলার সাত ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি ও মৎস্যখামারের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলি জমিসহ বিভিন্ন এলাকার আউশ ও সবজি আবাদ।
উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জুন মাসে দুই দফা পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্ট বন্যায় ঝিনাইগাতী উপজেলার সাত ইউনিয়নের ১ হাজার ৩০টি পরিবারের ৫ হাজার ১৫০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। বন্যায় ১৮টি কাঁচা ও পাকা সড়ক এবং মহারশি নদীর বাঁধের বিভিন্ন স্থানে দেড় কিলোমিটার অংশ ক্ষতি হয়েছে। ২৫টি ঘরবাড়ি ও ২৩টি বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮২টি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ি ঢলের আড়াই মাস পরও মহারশি নদীর পূর্বপ্রান্তে রামেরকুড়া, খৈলকুড়া ও নলকুড়া গ্রামে পাহাড়ি ঢলের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়ে গেছে। ঢলের পানির প্রবল তোড়ে ভেঙে যাওয়া ৮ থেকে ১০টি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। রামেরকুড়া-নলকুড়া সড়কের কমপক্ষে আটটি স্থানে ভেঙে গিয়ে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। এ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঢলের পানির তোড়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ায় রামেরকুড়া গ্রামের ১৫টি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এই এলাকার কয়েক একর আবাদি জমিতে লাল বালুর স্তর জমে আছে। ফলে আমন আবাদ করা সম্ভব হয়নি। রামেরকুড়া গ্রামে সেচনালার প্রায় ৪০০ ফুট অংশ ভেঙে গেছে। যেসব ঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে সেখানে এখন গাছপালা পড়ে রয়েছে।
উপজেলার রামেরকুড়া গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, আড়াই মাস আগে পাহাড়ি ঢলে তার একটি ঘর ভেঙে গেছে। কিন্তু টাকার অভাবে এখনো ঘর মেরামত করতে পারেননি। সরকার থেকে সাহায্য হিসেবে কিছু খাদ্যসামগ্রী পেয়েছেন। একই গ্রামের বাসিন্দা আবু হারেজ বলেন, পাহাড়ি ঢলে তার দুটি ঘর ভেঙে গেছে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে বিলম্ব হলে আপাতত চলাচলের জন্য নদীর পাড়ের ভাঙা অংশে মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে একাধিকবার পাহাড়ি ঢলের ফলে মহারশি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরসহ ঝিনাইগাতী বাজার ও সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। এতে পরিষদের কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই পাহাড়ি ঢলের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মহারশি নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান তিনি।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ বলেন, মহারশি নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে এলাকাবাসীর চলাচলের সুবিধার্থে নদীর পাড়ের ভাঙা অংশগুলো সংস্কার করা যায় কিনা, এ ব্যাপারে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপরদিকে পাউবো, জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাইদ বলেন, মহারশি নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে পাউবোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এটি ব্যয় সাপেক্ষ। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বাঁধ নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডিজ) উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
শেরপুর জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, মহারশি নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্ত্রণালয়ের সচিব আশ্বস্ত করেছেন।