ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘বাহে বাঁচি থ্যাকাই দায়’

‘বাহে বাঁচি থ্যাকাই দায়’

বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ খয়বার হোসেনের পাঁচ সদস্যের পরিবার। ভাড়ায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ভ্যান চালান। লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো ব্যাটারি চার্জ না করতে পারায় দিনের সামান্য অংশই রিকশা চালাতে পারেন। তাতে উপার্জন তলানিতে ঠেকেছে। সারাদিনে যা আয় হয় তার তিন ভাগের একভাগ দিতে হয় রিকশা মালিককে। এ উপার্জন দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বালাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খয়বার হোসেন। গত ২৪ আগস্ট সকালে তারাগঞ্জ বাজারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, বাহে বাঁচি থ্যাকায় দায়!! ছ্যাওয়া পোয়া নিয়্যা কি করি কোন কিছু বুঝবার পাইছং না।

খয়বার হোসেন আরো বলেন, ‘ভাই, আগোত একশ টাকা কামাই করিয়া ব্যাগ ভর্তি করি দুই তিনদিনের সবজি কিনার পাছনো। এ্যালা ব্যাগের কোণাও ভরে না। সারাদিনে সাড়ে তিনশ টাকা কামাই করোং। এ্যার মধ্যে একশ বিশ টাকা মালিককে দিবার নাগে। বাকি দুইশ তিরিশ টাকা দিয়া চাল তেল আর মসল্লা কিনতে শ্যাষ, তরকারি কিনার টাকা থাকে না। রাইত পোয়াইলে জিনিসের দাম বাড়ে। এ্যালা দুই বেলা খাবার যায়া দেনাত পরোছি।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছেন রংপুরের জুম্মাপাড়া গ্রামের দিনমজুর কালা মিয়া। তাঁর পরিবারেরও পাঁচ সদস্য। তাঁর একার দিনমজুরির টাকায় চলে সংসার। কালা মিয়া বলেন, ‘মানষের বাড়িত মাছ, গোস্তর গন্ধ শুনি। ছাওয়াগুলো খুব জেদ ধরলে ডিম আনিয়া খাই। এ্যালা তাকও আর হওচে না। হাটোত যায়্যা শোনোছুং ডিমেরও দাম বাড়ছে। এমনি তিন বেলার জাগাত দুই বেলা খাই, এ্যালা তাক এবেলাও হওছে না। জিনিসপাতির যে দাম। নুন দিয়া পান্তা খায়া বাঁচি আছি।’

শুধু খয়বার ও কালা মিয়াই নন, দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন রংপুর অঞ্চলের হাজারো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। এমনিতেই দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল রংপুর। তার মধ্যে লাগামহীন পণ্যের দামে অস্থির হয়ে উঠেছে জনজীবন।

আবুল কালাম আজাদ সমাজসেবার ইউনিয়ন কর্মীর চাকরি করেন। থাকেন রংপুর শহরে ভাড়া বাসায়। দুই ছেলে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়ে। মাসিক আয় তাঁর ২৫ হাজার টাকা। এ আয়ে আগে টেনেটুনে পাঁচ সদস্যের সংসার চললেও এখন আর চলছে না। ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে।

আবুল কালাম আজাদ জানান, বাড়িভাড়া বাবদ ৫ হাজার, দুই ছেলে স্কুলের বেতন ৪ হাজার ৯৯০ টাকা, ছেলেদের প্রাইভেট কোচিং ৬ হাজার ১৫০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ১ হাজার ৮০০ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ২ হাজার, গ্যাস বিল ১ হাজার ৩৫০ টাকা, ইন্টারনেট-মোবাইল বিল ৫০০ টাকা, চাল ১ হাজার ৫০০ টাকা, ৫ লিটার তেল ৯৫০ টাকা, চিনি ৫ কেজি ৫০০ টাকা, আটা ২০ কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা, সবজি ৩ হাজার টাকা, মাছ-মাংস ৩ হাজার ৫০০ টাকা, মরিচ-পেঁয়াজ-হলুদ-মসলা ৩ হাজার টাকা, ডিম ৩০টি ৪০০ টাকা, সাবান-পাউডার-কসমেটিকস ২ হাজার টাকা, কাপড় গড়ে ২ হাজার টাকাসহ প্রতি মাসে প্রায় ৩৯ হাজার ৮৪০ টাকা লাগে। এতে অতিরিক্ত প্রায় ১৪ হাজার ৮৪০ টাকা ধার দেনা করতে হয়।

আবুল কালাম আরও বলেন, বেঁচে থাকা এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে। কিছুতেই তাল মিলিয়ে চলা যাচ্ছে না। চাকরির টাকায় এখন সংসার চলছে না। মোটা অঙ্কের ধার করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়া আমার মতো অনেক চাকরিজীবী সংসার চালাতে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে মরছে।

জলুবার জেলেপাড়া গ্রামের জেলে চন্দন দাসের নদীতে মাছ ধরে চলে তাঁর পরিবার। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় তিনিও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চার সন্তান, বৃদ্ধা মা আর স্ত্রীকে নিয়ে সাত সদস্যের সংসারে এখন প্রায় উপোস থাকতে হয় তাঁকে।

চন্দন দাসের স্ত্রী জয়ন্তী বালা জানান, আধপেট দুই বেলা খেতে গেলে সাড়ে ৩ কেজি চাল লাগে, যার দাম ১৮০ টাকা, দুই কেজি সবজি ৮০ টাকা, আধা পোয়া তেল ২৫ টাকা, লবণ, কাঁচামরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন মসলা ৫০ টাকা, ওষুধ লাগে ৩০ টাকা, চার সন্তানের নাশতা বাবদ ২০ টাকা। চন্দন দাস আক্ষেপ করে বলেন, দাদা, এবার বান-বাইষ্যা নাই, নদী-নালাত মাছও নাই। মাঠত কামও নাই। নদীত সউগ দিন মাছও পাওয়া যায় না। এ্যালা সারা দিনে যেকনা মাছ পাই তাক দুই আড়াইশ টাকাত বেচাই। বাজারোত জিনিসপাতির খুব দর। তাক দিয়া একবেলা পেট ভরে খাবার পাই না। ছাওয়া পোয়াগুলা নিয়া উপাসে কষ্টে দিন কাটোছে।

ছুটমেনানগর গ্রামের আজাহারুল ইসলামের এক একর জমি চাষের আয়ে সংসার চলে। এক ফসল বেচে অন্য ফসলের চাষ করেন। ইকরচালী কাঁচা বাজারে কথা হলে আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘বাপ-দাদা কছলো, কৃষক হইল দ্যাশের প্রাণ। কৃষকের ফসলে দ্যাশের মানুষ বাঁচে। সউগ বাদ দিয়া আবাদোত নাগছি। এ্যালা তো দেখুছি সেটা ভুল। আবাদ করিয়া এ্যালা খরচে ওঠে না। পেট চালামো কেমন করি। সরকার তেলের দাম, সারের দাম বাড়াওছে হঠাৎ করি। হামার ধানের দাম তো বাড়ায় না। আর যখন ধানে দাম বাড়ায় তখন কৃষকের ঘরোত ধানে থাকে না। লোকসান দিয়া, ধারদেনা করি এইংকা করি আর কদ্দিন বাঁচমো কন?

জুম্মাপাড়া গ্রামের হোটেল শ্রমিক বাউরা মিয়া বলেন, ভাই দ্যাশোত কী হইল? হঠাৎ করি তেলের দাম, চাউলের দাম, তরিতরকারি দাম বাড়িল। এ্যালা একদিনের কামাই দিয়া দুইবেলা খাবার পাই না। সউগ জিনিসের দাম বাড়ছে তা সরকার হামার কামের দাম বাড়াওছে না ক্যান? ভালো করি নেখি দেন সরকার যেনো হামারও দাম বাড়ায়। আর পোষাওছে না।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ আহমেদ বলেন, দেশের দারিদ্র্যের হার ৮২ ভাগ রংপুর বিভাগে। এই বিভাগের খেটে খাওয়া মানুষগুলো দ্রব্যমূল্যের এই পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মিলাতে পারবে না। বিধায় তাদের জীবন চলবে খেয়ে না খেয়ে। সরকার ও বিত্তবানদের উচিত এই অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষগুলোর জন্য রেশন প্রথা চালু করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন