দেশে পেঁয়াজ নিয়ে প্রায়ই সংকট ও জটিলতা দেখা দেয়। তাই দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ মসলার উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু এটার সংরক্ষণ নিয়ে সক্ষমতার অভাব ছিল দীর্ঘ দিনের। এবার সংরক্ষেণেও এসেছে নয়া প্রযুক্তি।
ফরিদপুরের কৃষকের কাছে এরই মধ্যে ‘পেঁয়াজের এসি’হিসেবে বেশ সমাদৃত হয়েছে এয়ার ফ্লো মেশিন। কম খরচে পেঁয়াজ সংরক্ষণে জেলাজুড়ে বেশ সাড়া ফেলেছে মেশিনটি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমন্বিত পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) পরামর্শক দল এই এয়ার ফ্লো মেশিনটি উদ্ভাবন করেছে।
ফরিদপুরের সালথা ও সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে দেখা গেছে। একটি ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর মাদুর বা বাঁশের চাটাই বিছিয়ে তার মধ্যে এই যন্ত্রটি স্থাপন করে তারা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। এভাবে বছরের আট মাস পর্যন্ত একশো বর্গফুট জায়গায় প্রায় তিনশো মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এতে মাসে মাত্র পাঁচশো থেকে ছয়শো টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়। এর বাইরে কোনো অতিরিক্ত ব্যয় নেই।
সাধারণ বাজারে নতুন পেঁয়াজ ওঠার পরেই দাম কমতে থাকে। এজন্য কিছুদিন সংরক্ষণ না করতে পারলে চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পান না। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের মাচা বা চাঙে পেঁয়াজ সংরক্ষণে অধিক তাপমাত্রায় ঘেমে যাওয়া, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পে পচন ধরা ও রং নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেন তারা। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়িত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমন্বিত পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরামর্শক দলের ভ্যালুচেন বিশেষজ্ঞরা ‘বায়ুপ্রবাহ যন্ত্রের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংরক্ষণ’ প্রযুক্তির এই এয়ার ফ্লো মেশিনের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংরক্ষণ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর ছিদ্রযুক্ত মাদুর বা বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে তার মধ্যে সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ও ১৪ ইঞ্চি চওড়া একটি ভার্টিক্যাল সিলিন্ডার বসানো হয়েছে। এক হর্স পাওয়ারের একটি বৈদ্যুতিক মোটর যুক্ত করে পাখার সাহায্যে ওপর থেকে বাতাস টেনে নিচে নামিয়ে নেওয়ার পর আটকে থাকা বাতাস পেঁয়াজের মধ্যে দিয়ে বের হচ্ছে। ছোট্ট একটি কক্ষে এভাবে বাতাস প্রবাহ করে মজুত করা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের পেঁয়াজ চাষি মো. হায়দার শেখ বলেন, গতবছর থেকে আমি এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ রাখতে শুরু করি। এতে আগের চেয়ে অধিক বেশি সময় ধরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারছি। এখান থেকে বীজও তৈরি করা যায়। এভাবে রেখে এখন ২৫০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছি।
সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আব্দুর রহিম শেখ বলেন, আমি এবার তিনশো মণের অধিক পেঁয়াজ পেয়েছি। আগে চাঙে খামাল দিয়ে পেঁয়াজ রাখতাম। ফলে অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হতো। এবছর এই মেশিন দিয়ে পেঁয়াজ রাখার পর আর আগের মতো পচে না। এই মেশিনে অনেক সুবিধা হয়েছে।
সালথার গট্টি ইউনিয়নের ঝুনাখালী গ্রামের আমজাদ মাতুব্বর বলেন, এই মেশিনে শুধু পেঁয়াজই নয়, বীজও খুব ভালো হয়। এতে পেঁয়াজের রং এবং গুণগত মান ভালো থাকে। প্রতি মণে আগে চার থেকে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ পচে যেত। কিন্তু এভাবে পেঁয়াজ রেখে আমি সাড়ে তিনশো মণ পেঁয়াজের মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ পচা পেয়েছি।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমন্বিত পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) ভ্যালুচেন স্পেশালিস্ট গাজী মো. আব্দুল্লাহ মাহদী বলেন, একটি ভার্টিক্যাল সিলিন্ডারে মোটর সংযুক্ত করে ছোট একটি কক্ষে এই পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়। এই মেশিনের মাধ্যমে নিচে বাতাস টেনে আটকে দেয়। পরে সেই বাতাস পেঁয়াজের ভেতর দিয়ে বের হতে বাধ্য হয়। এতে পেঁয়াজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে পেঁয়াজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে। পেঁয়াজ পচে না। নষ্ট পেঁয়াজ থাকলে সেটি নিজে থেকেই শুকিয়ে যায়, পাশের পেঁয়াজকে নষ্ট করত পারে না।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সিনিয়র ফ্যাসিলিটেটর অধীর কুমার বিশ্বাস জানান, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায় মোট ৪১টি স্থানে এই মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এ মেশিন কৃষকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। দিনদিনে চাহিদা বাড়ছে।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসএমও স্পেশালাইজড ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালে মোহাম্মদ তোফায়েল চৌধুরী বলেন, পেঁয়াজ চাষিদের জন্য এ মেশিনটি বেশ সুফল বয়ে এনেছে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের এই প্রযুক্তিটি অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এই মেশিনের মাধ্যমে ১২ মাসের কমপক্ষে আট মাস পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এতে সংরক্ষিত পেঁয়াজের ওজন হ্রাস শতকরা ত্রিশ শতাংশ। পচন প্রায় শূন্য শতাংশ। মেশিনটি স্থাপন করতে খরচও কম। একটি মেশিন স্থাপনে খরচ হয় মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।