‘বিজ্ঞান মানুষকে পালন করে। ধর্ম মানুষকে পালন করে না, বরং মানুষ ধর্মকে পালন করে এবং প্রতিপালনও করে’-উক্তিটি দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের। বরিশাল জেলার সদরউপজেলাধীন চরবাড়িয়া ইউনিয়নের কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী অজপাড়াগাঁ লামচড়িতে জন্ম নেওয়া এ শতাব্দীর সর্বাধিক আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান। জীবদ্দশার ৮৬ বছরের ৭০ বছর কাটিয়েছেন যে মানুষটি গ্রন্থাগারে, তার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারে আজ অন্ধকার। নিয়মিত খোলা হয় না গ্রন্থাগার। ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রন্থাগারে অনিয়মের অভিযোগ। আরজ আলীর স্বজনরা জানান, নদীভাঙনের কবলে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে গ্রামটি। কীর্তনখোলা গ্রাস করেছে আরজ মঞ্জিলে আসার পথ। ফলে এখন যারা আসেন, তাদের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। যে কারণে দর্শনাথী বা বইপ্রেমীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। শুধু তা-ই নয়, আরজ আলীর প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার যেন বন্ধ হয়ে যায়, সে জন্য স্থানীয় কট্টরপন্থীদের ষড়যন্ত্র এখনো চলমান। তারাই মূলত আরজ মঞ্জিলের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এদিকে নদীভাঙন ও বিরোধিতার কারণে আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মদিন উপলক্ষে ‘আরজ মেলা’ কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চরবাড়িয়া ইউনিয়নের গনির হাট থেকে একটু সামনে এগিয়ে নির্মিত গ্রামরক্ষা বাঁধটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। গনির হাট থেকে নদীগর্ভে বিলীন আরজ আলীর বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথ না থাকায় কমপক্ষে এক কিলোমিটার পথ স্থানীয়দের বাড়ির ভিটে, উঠান, বাগান পায়ে হেঁটে গিয়ে পৌঁছাতে হয় আরজ মঞ্জিলে। এখনো ভালো পরিবেশ না হওয়ায় দর্শনার্থীরা এসে গ্রন্থাগারে বই পড়ার কোনো পরিবেশ পান না। এমনকি কালেভদ্রে খোলা হয় জ্ঞানচর্চার এই পিঠস্থান। এলাকাবাসীর দাবি, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরাসরি দেখভাল করলে আরজ মঞ্জিল তার জৌলুস ফিরে পাবে। মানুষ জ্ঞানচর্চার সুযোগ পাবে। ব্যক্তির হাতে গ্রন্থাগারটি থাকলে ব্যক্তির সুবিধা আদায় হবে। আরজ দর্শনচর্চা অব্যাহত থাকবে না। গ্রন্থাগারটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আরজ আলী মাতুব্বরের নাতি ও গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক শামীম আলী মাতুব্বর। তিনি বলেন, কট্টরপন্থীদের বিরোধিতার কারণে আরজ মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা চান না দর্শনচর্চা হোক, সংস্কৃতিচর্চা হোক। জীবদ্দশায় আমার দাদা (আরজ আলী) জেলও খেটেছেন। সেই শত্রুর বংশ তো এখনো আছে। মূলত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমার দাদা একা লড়াই চালাননি, উত্তরাধিকার সূত্রে এখনো আমাদের লড়াই চালাতে হয়। গ্রন্থাগারের মাঠে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগের বিষয়ে বলেন, একটি ক্যারম বোর্ড বসিয়েছিলাম। স্থানীয় মানুষ যেন ওই উছিলায় এসে হলেও জমজমাট করে রাখে। কিন্তু বিরোধীয় চক্রটি সেটিকে জুয়া আখ্যায়িত করেছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা আদম আলী মাঝি বলেন, জীবদ্দশায় অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। তিনি এক কথার মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো দুই ধরনের কথা বলেননি। তিনি মানুষকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। শিশুদেরও সালাম দিতেন। এতে শিশুরাও তাকে সম্মান করত। আদম আলী বলেন, একটা মানুষ মারা গেলে তার সঙ্গে তো বিরোধ থাকে না। আরজ আলী মাতুব্বর তার মাকে অনেক ভালোবাসতেন। তার মা মারা যাওয়ার পর মৃত মায়ের একটি ছবি তুলেছিলেন। সে কারণে হুজুররা ফতোয়া দিয়ে তার (আরজ আলীর মায়ের) জানাজাও পড়াননি। শেষে নিজে তার মাকে মাটিচাপা দিয়েছেন। এ দুঃখ তার মনে ছিল। সে কারণে তিনি কট্টরতা মানতেন না। এ প্রতিবেশী মনে করেন, আরজ আলীর মুক্ত মানসিকতার চর্চাকে আরও ছড়িয়ে দিতে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
আরজ আলীর মুক্তমনের চর্চার আরেক প্রতক্ষ্যদর্শী আলম হাওলাদার বলেন, তার সামনে আমি চেয়ারে বসতাম না। তিনি জোর করে আমাকে চেয়ারে বসিয়েছেন। তিনি (আরজ আলী) বলেছেন, আমিও মানুষ, তুমিও মানুষ। তিনি অত্যন্ত সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন। আরজ আলীর সততা ধারণ করলেই একজন মানুষ আদর্শবান হতে পারবেন বলে জানান তিনি।
আরজ আলী মাতুব্বরের নাতি কবির হোসেন মাতুব্বর বলেন, আমাদের লাইব্রেরিতে আগে অনেক লোক আসত। এখন আসতে পারে না। আগে আরজ মেলা হতো প্রতিবছরের ৩ পৌষ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ। মানুষ আসবে কীভাবে? নদীভাঙনে রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে। তার দাবি, আরজ মঞ্জিল চালু রাখতে হলে নদীভাঙন রোধ করতে হবে। অন্যথায় কয়েক বছরের মধ্যে আরজ আলীর বসতবাড়িও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, নদীভাঙন রোধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। জিও ব্যাগ ফেলার প্রকল্প চলমান রয়েছে ব্যক্তিগতভাবে আরজ আলীকে আমি নিজেও পছন্দ করি। গ্রন্থাগার পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা যোগাযোগ করলে আমি আরজ মঞ্জিল উন্নয়নে কাজ করব।