ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঁধনহারা নদীর স্বপ্ন

বাঁধনহারা নদীর স্বপ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে সফর করবেন। তার সফর ঘিরে ইতোমধ্যে কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত নদী ও রাজনৈতিক বিষয়ে কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে দৈনিক আনন্দবাজারে। আজ প্রথম পর্ব- বাঁধনহারা নদীর স্বপ্ন।

‘এ জিস সাগর কি গঙ্গা, উস সাগর মে যায়। যা সুর সাঙ্গম না তাল মিলে, উস পরদেশ ভালা কিউ যায়ে?’ এটি বলিউড কিং খ্যাত শাহরুখ খান ও মাহিমা চৌধুরী অভিনীত ‘পরদেশ’ চলচ্চিত্রের সংলাপ। যার ভাবার্থ অনেকটা এমন, নদীর যেখানে মিলিত হওয়ার কথা সেখানেই মিলাতে হয়। অন্য কোথাও মিলালে তা ছন্দ হারায়। ১৯৯৭ সালে ভারতের ৫০তম বর্ষপূর্তিতে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উদ্ভুত একটি সমস্যার সঠিক সমাধান হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় গঙ্গার প্রবাহমান স্রোতকে। অর্থাৎ গঙ্গাকে তার চিরাচরিত স্রোতে ছেড়ে দেয়া হয়।

চলচ্চিত্রটি থেকে নদীর চিরাচরিত রূপকে নিজস্ব গতিপথে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানানোর দৃশ্য দেখতে পাই। অথচ বাংলাদেশ-ভারতে প্রবাহমান ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে দৃশ্যপট ভিন্ন। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে হিমালয় থেকে উৎসরিত তিনটি বৃহৎ নদী- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পললে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে অন্তত ৪০৫টি নদী। আর আন্তঃসীমান্তে ৫৭টি নদীর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৫৪টি নদী। যার মধ্যে ভারতে উৎপত্তি হয়েছে ৫৩টি আর বাংলাদেশে একটির। বাকি ৩টি অভিন্ন নদী রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমানায়।

আবহমানকাল ধরেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে এসব নদীকে ঘিরে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১৭ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এ নদীগুলোর অন্যান্য অববাহিকাভূক্ত দেশ হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীন।

ব্গিত ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছরের যে চুক্তি হয়েছিল তা ইতোমধ্যে ২৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আর মাত্র ৪ বছর পর ২০২৬ সালে শেষ হবে চুক্তি। যদিও চুক্তিতে যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা ছিল তা ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। আবার তিস্তার পানিচুক্তির বিষয়টি আটকে আছে এক যুগ ধরে। গত ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে এটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একমুখিতার কারণে আজও হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে গত ২৩ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে যৌথ নদী কমিশনের (জয়েন্ট রিভার্স কমিশন বা জেআরসি) ৩৮তম বৈঠক। আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি সফর ঘিরে জেআরসি বৈঠকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

এ বিষয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ধরলা, দুধকুমার, মনু, খোয়াই, মুহুরী, গোমতীর পানিবণ্টন নিয়ে জেআরসি বৈঠকে আলোচনা হবে। তাছাড়া সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা ও একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত (এমওইউ) হবে। কুশিয়ারায় সেচের জন্য পাম্পহাউজে পানি আনতে চুক্তি হবে। এছাড়া আরও ৮টি নদীর পানিসহ মোট ১৪টি নদী নিয়ে আলোচনা হবে।

পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, তিস্তানদীর ড্রেজিং নিয়েও কথা হবে। কারণ এটি ড্রেজিং করতে দরপত্র চালু আছে। সেখানে ভারত ও চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। ড্রেজিংয়ে বেশকিছু সমস্যাও আছে। যেমন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তথা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ২০টি পয়েন্টে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে ড্রেজিং করা যাচ্ছে না। এসব বিষয় সুরাহায় আলোচনা হবে।

তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে জাহিদ ফারুক বলেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছিল ২০১১ সালে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকালে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যয়ের কারণে তা হয়নি। এটি নির্ভর করছে বন্ধুপ্রতিম ভারতের সদিচ্ছার ওপর। গঙ্গা নদীর পানি চুক্তির ব্যাপারেও কথা হবে।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, দুই পক্ষ এক সঙ্গে কাজ করলে নদীর অনেক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সেজন্য রিভার প্রটেকশন ওয়ার্ক করার প্রস্তাবও দেয়া হবে। নদী শাসন ও সুরক্ষা দু’দেশ একসঙ্গে না করলে প্রকৃত উপকার হবে না।

জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ মির্জা তারেকুল কাদের বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর পর দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ের  বৈঠক বসেছে। বাংলাদেশকে ভারত তিস্তার পানি দিচ্ছে না। পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে আমরা বঞ্চিত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আলোচ্য সূচিতে কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টনের কোনো কথাই নেই (ভারত নাকি অন্য নদীর কথা বলছে)। আমরা চাই তিস্তার পানি, তিস্তার পানি।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক, জল ও পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ছয়টি নদীর পানি নিয়ে জেআরসিতে আলোচনা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার এজেন্ডা হওয়া উচিত গঙ্গা ও তিস্তা। আরেকটি বৃহত্তম অভিন্ন নদী ব্রহ্মপুত্র ইস্যুও আলোচনার টেবিলে আনার এটাই সময়। ২০১০ সালে জেআরসির ৩৭তম বৈঠকটি হওয়ার পর আর বৈঠক অনুষ্ঠানই সম্ভব হচ্ছিল না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ মুহূর্তে জেআরসির বৈঠকটি স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। অথচ ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, জেআরসির বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বছরে অন্তত চারটি বৈঠক হওয়ার কথা। কিন্তু এক যুগ ধরে একটি বৈঠক করাও সম্ভব হচ্ছিল না। অবশ্য শুরু থেকেই এ ধরনের বৈঠকের ব্যাপারে ভারতের অনাগ্রহ পরিলক্ষিত। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যে খুব জোর দাবি এসেছে, তা-ও সব সময় দেখা যায়নি। ২০১৯ সালের বৈঠকটি স্থগিত হয়েছিল মূলত দুই দেশের দিক থেকে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সংক্রান্ত প্রস্তুতিহীনতায়। দেরিতে হলেও জেআরসির বৈঠকটি যেহেতু হচ্ছে, আশা করব- উভয় দেশই অভিন্ন নদী-সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত ও ন্যায্য মীমাংসায় উদ্যোগী হবে। ভুলে যাওয়া চলবে না বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি।

‘এসব আন্তঃসীমান্ত নদীর সমস্যা আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করার সুযোগ আছে কিনা, যেমনটা সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে করা হয়েছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদী সম্পর্কে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের একটি কনভেনশন আছে। বাংলাদেশ এটি মানলেও ভারত মানতে প্রস্তুত নয়। আইন না মানলে সালিশ তো হয় না। তবে এখন ব্রহ্মপুত্রের বিষয়েও জোর দেয়া দরকার। গঙ্গা ও তিস্তা তো থাকবেই।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক এ ব্যাপারে আরও বলেন, তাছাড়া ভারতের সঙ্গে সব নদী নিয়েই চুক্তি হওয়া দরকার। কেননা জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোকে এমনভাবে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে যেখানে ভাটির দেশ পানি পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। দানিউব, নীল নদ, মেকং আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়ায় ১০-১২টি দেশ মিলে যৌথব্যবস্থাপনা করছে। অথচ বাংলাদেশ-ভারত পারছে না।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো থাকলেও নদীর ক্ষেত্রে তার বিপরীত। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে ১২ বছর যাবৎ ঝুলে আছে তিস্তা চুক্তির বিষয়। ২০১১ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিপরীতমুখি আচরণের কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও সেটি হয়নি। ১২ বছরেও সেটি কোনো সুরাহা হলো না। এটিতো ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় আমরা সেখানে কেন পিছিয়ে থাকবো বা মমতাকে রাজি করাতে যাবো। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব তার রাজ্যগুলোর সমস্যা সমাধান করা।

অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার আরও বলেন, ১২ বছর পরে যৌথনদী কমিশনের বৈঠক হচ্ছে। অথচ বৈঠকের আগে দেশে বড় ধরনের বা জাতীয় পর্যায়ের কোনো সেমিনারই হলো না। আমাদের কী প্রয়োজন সেই তথ্য-উপাত্তও তেমন হাতে নেই। এমন প্রস্তুতিহীন বৈঠকে লাভ কি হবে? দেশে নদীবিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবী ও নদীর সঙ্গে যাদের জীবনধারা সম্পৃক্ত তাদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা নেয়া উচিত ছিল। আমাদের প্রশাসন সেদিকে নজর দেয়নি।

অধ্যাপক কামরুজ্জামান মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো সমস্যার সঠিক সমাধান হয় না। ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত নদীর ব্যাপারে যৌথ কোনো উদ্যোগে যেতে পারছে না। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভালো ফল এসেছে। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ফলে কিন্তু নদীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। শুধু গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সুরাহা হয়নি। ৫৪টি নদীর পানিপ্রবাহ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে ঐক্যমত হতে না পারলে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখিয়ে ভারত উপেক্ষা করছে, তাতে কি তাদের দেশের রাজ্যগুলো ক্ষতির মুখে কম পড়ছে? এক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্তের নদী নিয়ে অভিন্ন নীতিমালাতে যেতেই হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন