আষাঢ় ও শ্রাবণ পেরিয়ে গেলেও উত্তরাঞ্চরে এ বছর তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে পানি সংকটে সদ্য রোপণ করা আমন চারার খেতে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। বাধ্য হয়ে ফসল রক্ষায় গভীর-অগভীর নলকূপ চালুর মাধ্যমে জমিতে সেচ দিতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে চাষীকে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি আমন মৌসুমে উত্তরের ১৬ জেলায় সেচ দিতেই প্রায় ৮১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে চাষিকে।
এদিকে, সেচে বাড়তি খরচ যখন কৃষকের গলায় কাঁটা, সে মুহূর্তে বাজারে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দাম নেয়ার অভিযোগ ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। বেশি দাম দিয়েও চাহিদামতো ইউরিয়া ও এমওপি সার না পাওয়ায় আমন আবাদ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ডিজেলের দাম কমানোসহ ডিলার পর্যায়ে সার মজুদে নিয়মিত মনিটরিংয়ের দাবি চাষিদের।
এদিকে আবহাওয়া অফিস বলছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর জনু-জুলাই-আগস্টে বৃষ্টি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ কম। রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেছেন, বর্ষা মৌসুমের তিন মাসে উত্তরের ১৬ জেলায় বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৯৭৮ মিলিমিটার। অথচ গত বছর এই তিন মাসে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ২ হাজার ৯’শ মিলিমিটার। তবে এ বছর আর তেমন বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা নেই জানিয়ে এই কর্মকর্তা জানান, ফসল আবাদ এখন কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেচনির্ভর ফসলে কৃসক সুফল পাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পরিবেশবিদ ও গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ মনে করছেন, প্রকৃতি মানুষের কারণেই তার গতি পরিবর্তন করেছে। কখন বৃষ্টি আর কখন খরা হবে তা বলাটা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই প্রকৃতির অভিশাপ এখন মানুষকেই বইতে হবে। কৃষি থেকে শুরু করে নিত্য জীবনযাপনে এর প্রভাব পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে ২৫ লাখ ৮৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এরই মধ্যে ১৭ লাখ ৬১ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ শতাংশ।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, এ বছর আষাঢ় মাসজুড়ে উত্তরের জেলাগুলোতে বৃষ্টির দেখা মেলেনি। আবার শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ বৃষ্টি না হওয়ায় সব মাঠের জমি তীব্র খরায় ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে আমন ধানের চারা রোপণ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়েছিল চাষিদের। এরপর ৮-১৯ শ্রাবণ পর্যন্ত উত্তরের ৭২টি উপজেলায় শুরু হয়েছে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত। খরায় ফেটে চৌচির সব মাঠের জমি আবারো সতেজ হতে শুরু করেছে। সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং কিছুটা সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা রোপণ করেছিলেন চাষীরা।
এরই মধ্যে আবারো টানা দুই সপ্তাহ যাবৎ বৃষ্টিহীন। এতে আমন ধানের খেত শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। মাঠের সব গভীর-অগভীর নলকূপ চালুর মাধ্যমে জমিতে সেচ দিয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা করছেন চাষীরা। এরই মধ্যে গত ৬ আগস্ট থেকে দেশে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ৩৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। উত্তরের কৃষি খাতে যার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে গড়ে ৩০০ টাকার ডিজেল প্রয়োজন হতো। সেখানে মূল্যবৃদ্ধির পর এখন এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে গড়ে ৪০০ টাকা খরচ পড়বে।
খরার কবলে পড়া আমনের খেতে এরই মধ্যে কমপক্ষে তিনবার সেচ দিতে হয়েছে চাষীকে। এ মৌসুম এভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত চললে কমপক্ষে আরো চারবার সেচ দিতে হবে। সেই হিসাবে উত্তরের প্রায় ২৬ লাখ হেক্টর জমির আমনের ফসল রক্ষায় এবার সেচের খরচ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৮১৩ কোটি টাকা।
এদিকে, প্রতি কেজি ইউরিয়া সার ২২ টাকা ও প্রতি কেজি এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ১৫ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে ৭২টি উপজেলার হাটবাজারে এসব সারের কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। সংকট সৃষ্টি করে কৌশলে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন ডিলার ও ব্যবসায়ীরা। বাড়তি দাম দিয়ে সার কিনতে গেলেও চাহিদা মতো সার না পাওয়ায় বাজার থেকে ফেরত আসতে হচ্ছে চাষিকে।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের মমিনপুর গ্রামের কৃষক শাহা আলম বলেন, মাঠে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও কিছুটা সেচ দিয়ে ১২ বিঘা জমিতে আমন ধানের আবাদ করেছি। মাঝখানে কিছুদিন হালকা বৃষ্টিপাত হলে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয়নি। তবে গত ২ সপ্তাহ যাবৎ একেবারেই বৃষ্টির দেখা নেই। এ মুহূর্তে জমি কোনোভাবেই শুকিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। তাই বেশি দামে ডিজেল কিনেই সেচ দিতে হচ্ছে। জমিতে চারা রোপণের ২১ দিন পর ইউরিয়া সার দিতে হয়। এমনিতেই বাড়তি সেচ খরচে আমরা অস্বস্তিতে আছি। এর মধ্যে আবার সরকার ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছে। ডিলারের কাছে সার কিনতে গিয়ে বর্ধিত দামের চেয়েও বেশিতে সার কিনতে হয়েছে। প্রতি কেজি ইউরিয়া সারে অতিরিক্ত ২ টাকা বেশি নিলেও চাহিদামতো সার দিতে পারছেন না ডিলাররা।
লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের চলবলা ইউনিয়নের শিয়াল খোওয়া গ্রামের কৃষক ও ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রের অপারেটর রিপন হোসেন বলেন, ১৩ বিঘা জমিতে স্বর্ণা-৫ জাতের ধানের আবাদ করেছি। আগে প্রতি বিঘা জমিতে সেচ দিতে ২৮০ টাকার ডিজেল হলেই যথেষ্ট ছিল। আর এখন ৪০০ টাকার ডিজেল লাগছে। এভাবে ডিজেল বেশি দামে কিনে সাত/আট বার সেচ দিতে গেলে বিঘাপ্রতি সেচ খরচই প্রায় ৩ হাজার টাকা পড়বে।
একই ইউনিয়নের শিয়াল খোওয়া বাজারের কুদ্দুস সার ঘরের সারবিক্রেতা এনামুল হক বলেন, উপজেলাজুড়ে সার সংকট। তাই বিভিন্ন ডিলার থেকে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার ২৫ টাকা ও এমওপি সার ৩১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। সারের বাজার পুরোটাই ডিলারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) রংপুর জেলা শাখার সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, ইউরিয়া ও এমওপি সার দুটোই আমাদের সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট এমওপি সারের। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ডিলারদের বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগটি সঠিক নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর আঞ্চলিক অফিসের উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সেচের মাধ্যমে আমন আবাদে চাষিদের এ বছর খরচ কিছুটা বেড়েছে। গত মাসে হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হলে কৃষক একযোগে দ্রুত ধানের চারা রোপণ করেছেন। একই সময় চাহিদাও বেড়ে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। জেলায় গত মাসে বরাদ্দকৃত সারের কেবল অর্ধেকটা সরবরাহ পাওয়া গেছে। বাকি সার দ্রুত সরবরাহ পেতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভায় ৫টি উপজেলায় কী পরিমাণ সারের চাহিদা রয়েছে, তার সঠিক পরিমাণ জানাতে উপজেলা কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।