ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বাসের তরীতে ভাসা

বিশ্বাসের তরীতে ভাসা

ভূমির মালিকানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ তিন দাবি

  • ব্রিটিশরা মজুরি দিত ছিদ্র পয়সা: নৃপেন পাল
  • দুশ বছর ধরে বসবাস করা ভূমিতে নেই মালিকানা: রাজু গোয়ালা

আবারো চা শ্রমিকরা বিশ্বাসের ভরসায় তরী ভাসালো। তিনশ টাকা মজুরি দাবিতে দীর্ঘ ১২ দিন আন্দোলন করে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে ওপর ভরসা রেখে স্থগিত করে কাজে নেমেছেন। সেই ১৮৪০ সালে ব্রিটিশরা সপ্তাহে দিতেন একটি ছিদ্র পয়সা যাকে সে সময় বলা হতো কানা কয়েন। সেই বঞ্চনা দিয়ে শুরু জীবনটির শোষণ চলছে এই আধুনিক যুগেও। এখন মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে করতে হয় দিনানিপাত। শতাব্দি ধরে যে বংশপরম্পরায় তাদের বসবাস সেখানেও নেই মালিকানা। গত রবিবার রাতে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় আপাতত আন্দোলন স্থগিত রেখে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। তবে শ্রমিকদের কিছু অংশ আবারও সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চায়।

এর আগে গত রবিবার রাত ৯টায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চা শ্রমিকনেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রেখে আগের ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। দুই পক্ষ যৌথ বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের সভাপতিত্বে বৈঠকে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, বিভাগীয় শ্রম দপ্তর শ্রীমঙ্গলের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দীসহ বিভিন্ন ভ্যালির সভাপতিরা উপস্থিত ছিলেন।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের প্যাডে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে সভার সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তাঁর সম্মানে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে সোমবার (গতকাল) কাজে যোগ দেবে। আপাতত চলমান মজুরি ১২০ টাকা হারেই শ্রমিকরা কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে পরবর্তী সময়ে মজুরির বিষয়টি নির্ধারিত হবে। আসন্ন দুর্গাপূজার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হওয়ার জন্য চা-শ্রমিকনেতারা আবেদন করেছেন, যা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানানো হবে। চা-শ্রমিকের অন্যান্য দাবি লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হবে। সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। আর বাগান-মালিকরা চা-বাগানের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ধর্মঘটকালীন মজুরি শ্রমিকদের পরিশোধ করবেন।

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, আমরা আবারও প্রধানমন্ত্রীর ভরসায় তরী ভাসালাম। তিনি ভারত সফর শেষে এসে আমাদের সঙ্গে বসবেন। তিনি ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করবেন। যদিও ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা বঞ্চিতই হয়ে আসছি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভরসা রাখলাম। নিজেদের সূচনা মজুরির কথার করুণ কথা শুনালেন নৃপেন পাল। বলেন, ব্রিটিশরা একটি ছিদ্র পয়সা দিত। সেই পয়সা দিয়ে নির্দিষ্ট দোকান থেকে খাদ্যসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো হতো। সেই যে বঞ্চনার শুরু তা আধুনিক যুগেও থামছে না।

জানতে চাইলে শ্রমিকরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পূর্ণবিশ্বাস রেখেই আন্দোলন স্থগিত করছি। যাতে তিনি ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, আমরা দুশ বছর ধরে যে জমিতে বসবাস করছি সেই ভূমির মালিকানা আমাদের নেই। এখানে গাছ লাগালেও বাগান মালিকদের ট্যাক্স দিতে হয়। গরু-ছাগল পালন করলেও দিতে হয়। আমরা কৃতদাসের কৃতদাস।

রাজু গোয়ালা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি থাকবে ১. আমাদের ভূমির মালিকানা দিতে হবে,২. প্রতিটি বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করতে হবে, ৩, বাগানগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিক দিতে হবে, ৪. সেনিটেশনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, ৫. সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে ও ৬. ন্যায্য মজুরি (৩০০) নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজু গোয়ালা জানান, তারা যে জমিতে থাকেন সেইসব জমি ব্রিটিশরা তাদের দিয়েছিল। বংশপরম্পরায় সেখানে দুশ বছর ধরে বসবাস করলেও সেখানে তাদের ভূমিতে অধিকার নেই। ৩০ ডিসিমল ঘরের জন্য প্রতিদিন দিতে হয় ৭৬ টাকা যা মাসিক হিসেবে ৪৫৬০ টাকা। গাছ রোপন করলেও মালিকদের ট্যাক্স দিতে হয়।

রাজু গোয়ালা বলেন, আমাদের নারীদের বেশিরভাগই জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। কারণ তারা যথা সময়ে প্রস্রাব-পায়খানায় যেতে পারে না। ঋতুস্রাবে দীর্ঘক্ষণ কাজে লেগে থাকায় ভালো কোনো কাপড়ও ব্যবহার করতে পারে না। ফলে তাদের মাঝে বাসাবাঁধে ক্যান্সার। এসব বাগানে সর্ব রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল। এই চিকিৎসা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সিলেট ভ্যালির সভাপতি আরও বলেন, আমরা কিন্তু এই ভূমিরই সন্তান। আমাদের আনা হয়েছে’ কথা বললে মনে বড় আঘাত লাগে। কেননা তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ ভারত একটি দেশই ছিল। শুধু একটি রাজ্য থেকে অপর রাজ্যে স্থানান্তর। অথচ আনা হয়েছে অভিযোগ তুলে এই ভূমিপুত্রদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই ভূমিপুত্রদের বঞ্চিত করে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে না। সম্ভব নয়।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট মীর নাহিদ আহসান বলেন, চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির আন্দোলনটি খুব দ্রুতই সমাধান হবে। যদিও এটির মূল দায়িত্ব শ্রম অধিদপ্তরের। আমাদের মৌলভীবাজারে যেহেতু বাগানের সংখ্যা বেশি সে কারণে আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখার স্বার্থে আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

চা-শিল্প লাভজনক ব্যবসা হলেও মালিকরা দাবি মেনে নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন কী ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে এসব প্রশ্নের জবাবে মীর নাহিদ আহসান বলেন, মালিকপক্ষকে বোঝানোর দায়িত্ব মূলত শ্রম অধিদপ্তরের। তবে জেলা প্রশাসক হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করছি। মালিক-শ্রমিক সবাইকে নিয়ে বসছি। আশা করি সবই দ্রুত সময়ে সমাধানে আসবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন