প্রকল্পে ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তরুণরা সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নিতে পারবেন: মোহাম্মদ সোলায়মান, উপপ্রধান, ফসল উইং, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন
কিছুদিন আগে বোরো মৌসুমে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলসহ প্রায় সারাদেশেই প্রকট আকারে ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এমনকি বেশি মজুরি দিয়েও মিলছিল না শ্রমিক। এমন সংকট প্রতিবছর তীব্র আকার ধারন করছে। গত পাঁচ বছরে ধানকাটা শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দৈনিক ১১০০ থেকে এক হাজারের নিচে মিলছিল না শ্রমিক। এতে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়ে লোকসান গুনতে হয় চাষিদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে কৃষিখাতে জড়িত কৃষকদের গড় বয়স ৫৪ বছর। এখানে তরুণদের অংশগ্রহণ একেবারেই কম। তারা কৃষিতে আগ্রহী না হওয়ায় আগামীতে কারা কৃষিখাতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কৃষিখাতের তথ্য বলছে, বর্তমানে খাতটিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ জড়িত।
তবে যে হারে কৃষিতে আগ্রহ কমছে তাতে আগামী এক দশক পরে এই হার নেমে ৩০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি আগামী দুই দশক পর তা আরও নেমে ২০ শতাংশ হতে পারে। এর ওপর আবার প্রতিবছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি হাতছাড়া হয়ে চলে যাচ্ছে অকৃষিখাতে। এমন বাস্তবতায় কৃষি উদ্যেক্তা তৈরি ও ব্যয় কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
সরকার ইতোমধ্যে যশোর অঞ্চলে ‘টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ’ নামের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ১৭১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২৭ সালের জুলাইয়ের মধ্যে। সম্প্রতি একনেক সভায় অনুমোদিত ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এর মাধ্যমে ১৮০০ শিক্ষিত তরুণ আর নারী কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। তাছাড়া কৃষিখাতে ১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়াতে ২৮ হাজার ৬২০ কৃষকের দক্ষতা বাড়ানো হবে। এতে ফসল সংগ্রহের ক্ষতি ১৫ শতাংশ কমানো হবে। সেই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় ২০ শতাংশ কমিয়ে লাভজনক করা হবে কৃষিকে।
শিক্ষিত তরুণদের কৃষিখাতে আগ্রহী করে তোলা আর উৎপাদন বাড়ানোর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে খুলনা বিভাগের ছয় জেলার ৩১ উপজেলায়। কৃষিবৈচিত্র্য বিবেচনায় এসব এলাকাকে সম্ভাবনাময় কৃষিঅঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাই করে এসব এলাকায় ঝুঁকিও পাওয়া গেছে। যার মধ্যে রয়েছে শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, ঘুর্ণিঝড় এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। ঝৃঁকি প্রশমনে প্রকল্পে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রযুক্তি, যেমন বজ্রশেল্টার ব্যবহারের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- দুই হাজার ৬৯২ ব্যাচ প্রশিক্ষণ, ৩৪ হাজার ৬৬২টি কৃষিপ্রযুক্তি প্রদর্শনীর আয়োজন, ৬২টি কৃষি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র ও ৩১৮টি বিদ্যুৎবিহীন কুলিং চেম্বার নির্মাণ, ৩০ হাজার ৯৫৯টি কৃষি সরঞ্জাম কেনা। এছাড়া রয়েছে ৯৩টি কৃষি প্রযুক্তি মেলার আয়োজন, ৩ হাজার ৪৪৬টি মাঠ দিবস পালন ও ১২৪টি উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণের ব্যবস্থা।
প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কৃষিপ্রযুক্তি প্রদর্শনীতে মোট ব্যয়ের ৩১ শতাংশ বা ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ, কৃষি উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে ১৮ শতাংশ বা ৩১ কোটি টাকা, প্রশিক্ষণে ২০ শতাংশ বা ৩৫ কোটি টাকা, কৃষি সরঞ্জাম কেনায় ৭ কোটি টাকা, কুলিং চেম্বার নির্মাণে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশ্য, কর্মকর্তাদের বেতনে ৮৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ভাতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেতনের তিনগুণেরও বেশি। অর্থাৎ ভাতায় বরাদ্দ ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতার বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণে কৃষিকে লাভজনক করতে উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যয় হ্রাস ও প্রযুক্তির প্রসার জরুরি। তাছাড়া তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিও অপরিহার্য। শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেও প্রকল্পটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরা হয়েছে। তাছাড়া জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে বলে প্রকল্পটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
প্রকল্পে অতিরিক্ত ভাতার বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রকল্প পরিকল্পনা) মো. ফরিদুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি নতুন এসেছেন জানিয়ে উপ-পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে উপ-পরিচালক (প্রকল্প বাস্তবায়ন) মতিউর রহমান বলেন, প্রকল্পের পরিচালক এখনো নিযুক্ত হয়নি। মন্ত্রলাণয় থেকে প্রশাসনিক আদেশ জারির মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা হবে। তাই প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানা নেই।
প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের ফসল উইংয়ের উপপ্রধান মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, জেলা-উপজেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বিনিয়োগ ছাড়াই শুধু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে তরুণরা উদ্যোক্তা হবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, এ প্রকল্পে ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে কৃষি মন্ত্রলায়ের অন্যান্য প্রকল্প ও কৃষি ব্যাংক, সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া যাবে।
প্রকল্পের ১২৪টি উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণের বিষয়ে মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, পার্শ্ববর্তী জেলায় সফল কোনো কৃষকের কৃষি খামার পরিদর্শন ও হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে মোটিভেশন দেয়ার জন্য এ ভ্রমণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বেতনের তিনগুণ ভাতা প্রদানের যৌক্তিকতার প্রশ্ন ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ঈদ বোনাসসহ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা মিলিয়ে টাকাটা বেশি দেখায়। তবে সরকারি বেতন-ভাতার বাইবে এক পয়সাও নেয়ার সুযোগ নেই।
তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে পরিকল্পনা কমশনের মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে বেশ কিছু ব্যয় হ্রাস করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে ২৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় কমনো হয়। এসবের মধ্যে মুদ্রণ-বাঁধাই, মনহারি সামগ্রী, কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জামসহ ১০টি খাতের ব্যয় বাদ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র নিয়ে আসা, পণ্য পক্রিয়াকরণ ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিকে ইতিবাচক হিসেবে প্রকল্পটি গ্রহণের সুপারিশ করে কমিশন।
প্রশিক্ষণের জন্য তরুণদের বাছাই করার প্রক্রিয়া বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলছেন, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে গঠন করা কমিটি এসব কাজ করবে।
উল্লেখ্য, পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় ৪৬৫টির বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আরও বেশ কিছু প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে শুধু কৃষিভিত্তিক ৩২টির বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত কৃষির আধুনিকায়নের প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশিষ্টরা।