ফজিলাতুন্নেসার কাছেও কবি চিঠি দিতেন বন্ধুর মাধ্যমে। শেষে কবির লেখা একটি চিঠির জবাব দেন ফজিলাতুন্নেসা। সে চিঠিতে কবিকে আর চিঠি না দেয়ার অনুরোধ জানান। কবি কথা দিয়েছিলেন আর চিঠি লিখবেন না। কিন্তু কথা রাখতে পারেন নি। এরপরও লিখেছিলেন বন্ধুর কাছে। ফজিলাতুন্নেসার কাছ থেকে বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেও কবি তাকে চিঠি লিখেছিলেন।
কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের লেখা চিঠি সৈয়দ আলী আশরাফকে দিলে তিনি নজরুল জীবনে প্রেমের অধ্যায় গ্রন্থে প্রকাশ করেন এই চিঠি। সৈয়দ আলী আশরাফ নজরুলের চিঠি পড়ে তাকে প্রেমের পূজারী বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৮ সালে ফজিলাতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে বিদায় সংবর্ধনায় কবি তার উদ্দেশ্যে একটি গান পরিবেশন করেন-
জাগিলে পারুল কিগো সাত ভাই চম্পা ডাকে
উদিল চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে
চলিলে সাগর ঘুরে অকাল মায়ার পুরে
ফুটে ফুল নিজ যেথায় জীবনের ফুল্লু শাখে।
থেকো নাকো স্বর্গ ভুলে এ পারের মর্ত্যকুলে
ভিড়ায়ো সোনার তরী আবার এ নদীর বাঁকে।
বিলেতে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে কবি গান লিখেন-
বাদল ঝড়ে মোর নিভে গেছে বাতি
তোমার ঘরে আজ উৎসবের রাতি।
তোমার আছে চাঁদ আমার মেঘের রাতি
তোমার আছে ঘর ঝড় আমার সাথী।
ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কবি খোদার প্রেমে মশগুল হয়ে লেখেন-
পর জনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে ভুলিও
এ জনমে যাহা বলা হল না
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা
যদি আসি ফিরে বেদনা দিও
হৃদয়ে যেথায় প্রেম না শুকায়
সেই অমরায় মোরে স্মরিও।
এ তিনজন ছাড়াও কবি যাদের সান্নিধ্যে জড়িয়েছিলেন তারা হলেন
রানু সোম, উমা মৈত্র, জাহানারা বেগম, শিল্পী কানন বালা দেবী।
রানু সোম (প্রতিভা বসু)
ঢাকার টিকাটুলিতে গান শেখাতে গিয়ে কবি রানু সোমের প্রেমে পড়েন। রানু সোম পরবর্তীতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন নাম হয় প্রতিভা বসু। গুরু-শিষ্যের সুন্দর সম্পর্কের মাঝে শুরু হয় নানা কানাঘুষা। মুসলমান কবি হিন্দু যুবতীকে গান শেখাতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলে একদিন রানু সোমের বাসা থেকে রাতে ফেরার পথে একদল যুবক কবিকে আক্রমণ করেছিল। রানু সোম কবিকে গুরু জ্ঞানে ভক্তি করতেন। অনেকের মতে তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।
উমা মৈত্র ওরফে নোটন
নার্গিস, প্রমিলা ও ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির জীবনে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়। অনেকে মনে করেন নজরুলের শিউলি মালা গল্প উমা মৈত্রের স্মৃতি নিয়ে রচিত। তাকে কবি গান শেখাতেন। উমা তৎকালীন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্র নাথ মৈত্রের মেয়ে। যার ডাক নাম ছিল নোটন। শিউলি মালা গল্পে কবি লিখেছেন-
একজন অসীম আকাশ
অন্যজন অতল সাগর।
কোন কথা নেই, কোন প্রশ্ন নেই,
শুধু এ ওর চোখে,ও এর চোখে
চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।
জাহানারা বেগম
অনেকে জাহানারা বেগমের সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল বলে মনে করেন। বর্ষাবানী নামক বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদিকা জাহানারা বেগমের সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় হয় দার্জিলিং এ ১৯৩১ সালে। জাহানারা বেগমের কাছে সংরক্ষিত কিছু গান ও কবিতা ছিল। যার মধ্যে তাকে নিয়ে লেখা কয়েকটি কবিতা ছিল। তবে কবি তাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি তেমনভাবে।
শিল্পী কানন বালা দেবী
শিল্পী কানন দেবীকেও কবি গান শেখাতেন। তাকে নিয়েও মুখরোচক কাহিনি রটেছিল। এমন কথা প্রচলিত ছিল যে- কবিকে কলকাতায় কোথাও না পাওয়া গেলেও কানন দেবীর বাড়িতে পাওয়া যাবে অবশ্যই। বাস্তব হয়তো অন্যরকম ছিল।
সত্য ও সুন্দরের কবি আজীবন প্রেমের কাঙাল ছিলেন। তাই প্রেম এসেছিল তার জীবনে বার বার। কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে, কখনো মনের অজান্তে। নারীকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে কবি ভালোবেসেছিলেন মানুষকে মানবতাকে, সত্যকে। মানবিক প্রেমকে ভালোবাসার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন কবি। বাকশক্তি হারাবার আগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির বিশেষ সভায় কবির মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল-
আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম,
প্রেম নিতে এসেছিলাম।
সে প্রেম পেলাম না বলে
আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে
নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ