গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই, তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। পরে তারা বিভিন্ন নথিপত্রের ছায়ালিপি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। শনিবার দিনব্যাপী গাজীপুর নগর ভবনে তারা তদন্ত কার্যক্রম চালান।
টেন্ডারবাজিসহ অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ করার পাশাপাশি বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভূয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত বছরের ২৫ নভেম্বর মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পরে অভিযোগ তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্যরা হলেন, যুগ্ম সচিব অনুপম বড়ুয়া এবং উপ-সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম।
গত ১০ জানুয়ারি থেকে প্রায় ৭ মাস ধরে তিন সদস্যর এ কমিটি তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সময়ের মধ্যে কমিটির সদস্যরা গাজীপুরে বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন, ভুক্তভোগী লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ, তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে সেগুলো পর্যালোচনা করেছেন। এছাড়া তদন্ত কমিটি একবার সাময়িক বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের শুনানী গ্রহণ করেছেন। বদলি জনিত কারণে তদন্ত কমিটির এক সদস্য অনুপম বড়ুয়া শনিবার উপস্থিত ছিলেন না।
শনিবার সন্ধ্যায় নগর ভবনে তদন্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) মোস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, কমিটি দিনভর জাহাঙ্গীরর আলমের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত বিভিন্ন অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এসময় তাদের বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ভূয়া দরপত্র, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দর দেওয়ার অনুরোধ সংক্রান্ত (আরএফকিউ) দরপত্রে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভূয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতি বছর হাটবাজার ইজারার টাকা যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না দেওয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থ খরচের অনিয়ম, ভূমি দখল ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণ সংক্রান্ত অভিযোগ, উন্নয়ন খাতের টাকা রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে ৯৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা কিভাবে কোথায় খরচ করা হয়েছে এরকম ১০টি অভিযোগের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ করছে। যাতে কোন বিষয় তদন্ত থেকে বাদ না পড়ে সে জন্য বিশেষ যত্ন ও গুরুত্ব সহকারে তদন্ত কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা চেষ্টা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে। এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের শুনানী গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি লিখিতভাবে জবাব দিয়েছেন। আমরা সেটি যাচাই করছি। তিনি আরো শুনানীতে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রয়োজন হলে আবারো তার বক্তব্য নেয়া হবে।
শনিবার সিটি কর্পোরেশনের যে সব কর্মকর্তাদের সাথে তদন্ত কমিটি কথা বলেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন, সিটি কর্পোরেশনের সচিব আব্দুল হান্নান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আকবর হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মজিবুর রহমান কাজল, হিসাব রক্ষক গোলাম কিবরিয়া, কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ।
জাহাঙ্গীর আলম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকাকালে গেল বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মোধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর গাজীপুর মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক আন্দোলন হয়। পরে গত বছরের ১৯ নভেম্বর দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলের সদস্যপদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
একই বছরের ২৫ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরেণকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করে।
অপরদিকে, অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ ভূয়া ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। দুদক উপ-পরিচালক নারগিস সুলতানা ও সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমানের সমন্বয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। গত ২৬ জুন দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বিষয়টি গণমাধ্যমে জানান। দুদক সচিব এ বিষয়ে বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ ভূয়া ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য একটি অনুসন্ধান টিম গঠনের প্রস্তাবসহ কমিশনের অনুমোদনের জন্য নথি উপস্থাপন করা হয়েছে।