মুসাফিরখানা! সময়ের পরিবর্তন আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষের তেমন আর প্রয়োজন হয় না। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কাছে মুসাফিরখানা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমতুল্য ছিল। কারণ সে সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুব কষ্টের। তখন দূর দূরান্তে যেতে হলে মানুষের বাহন বলতে ছিলো ঘোড়া কিংবা গরুর গাড়ি। পায়ে হেঁটেই অনেককে পাড়ি দিতে হতো মাইলের পর মাইল। সেই পথক্লান্ত পথিকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিলো মুসাফিরখানা।
তেমনি এক মুসাফিরখানা কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও রয়েছে উত্তরের জেলা নওগাঁয়। যেখানে এখনও ক্লান্ত পথিকের জন্য ফ্রিতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চাইলে আপনিও ফ্রিতে থাকতে এবং খেতে পারবেন এখানে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। ১১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মুসাফিরখানাটি জেলার পোরশা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা মিনা বাজারের অবস্থিত। যেখানে দূর-দুরান্ত থেকে আসা ক্লান্ত মানুষ নিরাপদে আর নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপন করতে পারেন। পরিবেশন করা হয় বিনামূল্যে খাবারও।
শত বছর আগে এ অঞ্চলের চারদিকটা ছিলো বিভিন্ন গাছগাছলি আর জঙ্গলে ঘেরা। পায়ে হেঁটে চলাই ছিল সে সময়ের একমাত্র উপায়। চোর ডাকাতের ভয়ে মুসাফিররা সন্ধ্যা নামলেই খুঁজতেন আশ্রয়স্থল। তাদের ভোগান্তি আর কষ্টের কথা চিন্তা করে ১৯০৮ সালে তৎকালীন জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ এখানে একটি মাটির ঘর তৈরি করে মুসাফিরদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে যে ঘরটির নাম দেওয়া হয় ‘মোসাফির খানা। জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ মুসাফিরখানা তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি, মুসাফিরখানার ব্যয় নির্বাহের জন্য দান করেন ৮০ বিঘা জমি। এক সঙ্গে ৬০ জন মুসাফিরের জন্য এখানে রয়েছে বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ মারা যাওয়ার পর মুসাফিরখানা পরিচালনার দায়িত্ব নেন তার বংশধর সিরাজুল শাহ্ চৌধুরী। বর্তমানে মাওলানা শাহ্ শরিফুদ্দীন চৌধুরী পরিচালনা করছেন মুসাফিরখানাটি।
স্থানীয়রা জানান, মুসাফিরখানাটি পরিচালনার জন্য জমিদার তার ৮০ বিঘা জমি দেন, যাতে মুসাফিরদের এখানে থাকা এবং খাওয়ার কোনো অসুবিধা না হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে আবার নতুন করে পাকা ভবন তৈরি করা হয়। দোতলা এ ভবনে ৫০ থেকে ৬০ জন থাকতে পারেন। ১১৪ বছর পরে এসে এখনও মুসাফিরখানাটি সব সময় অতিথিদের জন্য খোলা, থাকা খাওয়ার কোনো খরচ দিতে হয় না। ওই এলাকার প্রবীণদের ভাষ্যমতে, ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পর তৎকালীন বাদশা আলমগীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন শাহ্ বংশের কয়েকজন, এদের মধ্যে ফাজেল শাহ্, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ্, ভাদু শাহ্, মুহিদ শাহ্, জান মোহাম্মদ শাহ্, খান মোহাম্মদ শাহ্ অন্যতম। পরবর্তীতে তারা আসেন নওগাঁর পারশা উপজেলায়। এরপর এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে। তাদেরই বংশধর জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ। যিনি নির্মাণ করেন মুসাফিরখানাটি।
জেলা শহর নওগাঁ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুসাফিরখানাটিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাজারের প্রধান সড়কের সঙ্গে লাগানো লম্বা দ্বিতল ভবন। বড় করে সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। লেখা রয়েছে ‘পোরশা মোসাফির খানা’। মুসাফিরখানায় থাকতে হলে করতে হবে রেজিস্ট্রেশন। একজন মুসাফির এখানে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ তিনদিন। খাবার পাবেন দুপুর ও রাতে। তবে দুপুরের খাবারের জন্য সকাল ৯টা এবং রাতের খাবারের জন্য বিকাল ৪টায় জানাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। ভবনটিতে রয়েছে বিভিন্ন নকশায় শিল্পের সমারোহ। মেঝেতে গালিচা বিছানো। সব মিলিয়ে ১৬টি ঘর রয়েছে। রয়েছে খাট, তোষক, বালিশ ও ফ্যান। উত্তরপাশে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। ক্লান্ত পথিক সেখানে গোসল ও ওযু করে ক্লান্তি দূর করতে পারেন।
মুসাফিরখানাটির সেবক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কেউ দু’দিনের জন্য আবার কেউ তিন দিনের জন্য এখানে থাকেন। যারা থাকেন তাদের জন্য বিছানা প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো দেখভাল করতে হয়। প্রতিদিনই গড়ে ৮-১০ জন মানুষ এখানে আসেন। অনেক দূরদূরান্ত থেকে মুসাফিররা আসেন এখানে।
বর্তমানে এখানকার সার্বিক দায়িত্বে আছেন মাওলানা শাহ্ শরিফুদ্দীন চৌধুরী তিনি বলেন, ‘মুসাফিরখানার নামে ৮০ বিঘা জমি আছে। এ আয় থেকে খরচ করা হয়। এছাড়া স্থানীয়রাও অর্থ দিয় সহযোগিতা করে থাকেন। এখানে থাকা ও খাওয়া একদম ফ্রি। দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। যদি কেউ দুপুরে খেতে চান সকাল ৯টার মধ্যে এবং রাতে খেতে চাইলে বিকেল ৪টার মধ্যে বলতে হয়।’ এছাড়াও ‘প্রতি বুধবার দুপুরে এখানে স্থানীয় ও অসহায়দের একবেলা খাবার দেওয়া হয়। যেখানে প্রায় ৭০-৮০ জন খাবার খেয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ হয় রমজান মাসে।’
পোরশা মুসাফিরখানার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম শাহ বলেন, ‘এটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এলাকার বাইরের কেউ আসলে কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়াটা তার জন্য অত্যান্ত কষ্টের ছিল। এছাড়া কোথায় থাকবে বা কী খাবে তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাদের কথা মাথায় রেখে তৎকালিন জমিদার এই মুসাফিরখানা নির্মান করেন। তিনি আরো বলেন, মুসাফিরখানার নিজস্ব সম্পদ রয়েছে যা দিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া এলাকাবাসীও বিভিন্ন ভাবে এখানে সহযোগীতা করে থাকেন।