শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চায়ের দেশে দাসের জীবন

চায়ের দেশে দাসের জীবন

দাসত্বের জীবনকেও হার মানাচ্ছে চা শ্রমিকদের জীবন। দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে চলছে তাদের সংসার। গত ৮ আগস্ট থেকে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ১১দিন যাবত আন্দোলন করছে তারা। এই দাবির আওয়াজ কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। প্রশাসনের উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ছে না। অথচ দেশে প্রতিবছরই প্রসার ঘটছে চা শিল্পের। গড়ে উঠছে নতুন নতুন চা বাগান। লোকসান নয় বরং লাভের মুখ দেখছেন ধনাঢ্য বাগান মালিকরা। অথচ শ্রমিদের মানবেতর জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ নেই।

সূত্রমতে, ২০২০ সালে ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করে দেশে আয় হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালে রপ্তানি হয় ১৮ কোটি টাকার। অপার সম্ভাবনার চা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে প্রতিবছরই। তবে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে চা শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এলেও মানা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, কয়েক দফায় বৈঠক করেছি। কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

শ্রমিকদের দাবি করা ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নে শ্রম সচিব বলেন, এখন বলা যাবে না। বৈঠক হচ্ছে দেখা যাক কী হয়।

জানতে চাইলে একজন চা-শ্রমিকনেতা তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। বলেন, রাতের খাবারের জন্য এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা। একশ গ্রাম ডাল ১৫ টাকা। তেল, রসুন, সবজি মিলে ৯০ টাকা। সকালের নাশতা শুধু রুটি ও চা পানি। সবমিলে দিনে ১৭০ টাকার প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের বেতন মাত্র ১২০ টাকা। বাকি ৫০ টাকা কোথায় পাবো? ওই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একজন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা রাষ্ট্রেরই নিশ্চিত করার কথা। সেখানে আমরা ঠিকমতো খাবারই পাই না। বাকি চারটির কথা আর কী বলবো।

আরও পড়ুনঃ  এস আই আকবর গ্রেফতার

কৃষব কৃষ্ণ নামের এক নেতা বললেন, আমাদের জীবন দাসদের জীবনের চেয়েও খারাপ। ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। একঘরেই গরু, ছাগল, ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ছেলের বৌ নিয়ে থাকতে হয়। ঘরে খাবার নেই। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানো যায় না। মালিকদের ইউরোপ-আমেরিকায় বাড়ি থাকলেও আমাদের মতো শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর জায়গাটাই নেই।

নিত্যপণ্যের চড়া বাজারে জীবনের হিসাব কষতে গিয়ে কৃষব কৃষ্ণ বার বারই গুলিয়ে ফেলেন সবকিছু। এরপরও বলেন, দুই কেজি তেল ৪০০ টাকা, এক কেজি লবন ৪০ টাকা, পেঁয়াজ দুই কেজি ১১০ টাকা, রসুন এক কেজি ৮০ টাকা, আদা ৫০ টাকা, হলুদ ৬০ টাকা, মরিচ ৬০ টাকা, তরকারি ৫০০ টাকা। সবজি তিনশ টাকা, মাছ ৫০০ টাকা ও মাংস ৫০০ টাকা। এক মণ চাল ৬০ টাকা করে ২ হাজার ৪০০ টাকা। এক মণ আটা ১৬০০ টাকা। এক কেজি চা পাতা ২০০ টাকা ও ৮০ টাকা করে তিন কেজি চিনি ২৪০ টাকা। সবমিলে মাসিক ব্যয় ৬ হাজার ২৪০ টাকা। আর যদি শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও ১০০০ টাকা ধরা হলে ব্যয় হয় ৭ হাজার ২৪০ টাকা। অথচ একজন শ্রমিক ১২০ টাকা করে ৩০ দিনে ৩ হাজার ৬০০ টাকা বেতন পান। সে হিসেবে ৩ হাজার ৬৪০ টাকা ঋণ হয়।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র ১২০ টাকায় কি সংসার চলে? এ পর্যন্ত মালিক ও সরকার পক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। আমরা বাঁচার মতো মজুরি চাই। গত ৮ আগস্ট থেকে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন করছি। দৈনিক ৩০০ টাকা হিসেবে মাসিক ৯০০০ টাকা মজুরির দাবিতে। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনোভাবেই ঘরে ফিরবো না।

আরও পড়ুনঃ  নিরাপদ বিনিয়োগে পুঁজিবাজার

ব্রিটিশ আমলে ১৮৩৯ সালে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসাম ও সিলেটের পার্বত্য অঞ্চলে চা বাণিজ্য শুরু করে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৮৪০ সালে চা চাষ শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর গবেষণা করার পর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় চা এস্টেট থেকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে চা উৎপাদনকারী হিসেবে দশম স্থানে অবস্থান করছে। দেশে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে। এই শিল্প বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশে চা উৎপাদনের সঙ্গে প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী শ্রমিক যুক্ত।

বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভবিষ্যতে চা বাগানের রোপনযোগ্য ভূমির পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৬২ দশমিক ৭৩ একর। ২০২১ সালে একর প্রতি গড় চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৯৭ কেজি। এ খাতে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭ জন। মোট ক্ষুদ্রায়তন চা চাষির সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার।

চা উৎপাদন ও রপ্তানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, সাইপ্রাস, গ্রিস, চীন, জাপান, মরিশাস, মালয়েশিয়া, কানাডা, ভারত, ইতালি, কুয়েত, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ড, সলোমন আইল্যান্ড, ইউএই, ইউএসএসহ বিশে^র ২৩টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ২০২১ সালে ৯৬.৫১ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। সেখানে শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি করা হয়।

এছাড়া ২০২০ সালে উৎপাদিত হয়েছে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি ও রপ্তানি হয়েছে ২.১৭ মিলিয়ন কেজি। ২০১৯ সালে ৯৬.০৭ উৎপাদান ও শূন্য দশমিক ৬০ মিলিয়ন রপ্তানি, ২০১৮ সালে উৎপাদন ৮২.১৩ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৬৫, ২০১৭ সালে উৎপাদন ৭৮.৯৫ ও রপ্তানি ২.৪৭, ২০১৬ সালে উৎপাদন ৮৫.০৫ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৪৭, ২০১৫ সালে উৎপাদন ৬৭.৩৮ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৫৫, ২০১৪ সালে উৎপাদন ৬৩.৮৮ ও রপ্তানি ২.৬৬, ২০১৩ সালে উৎপাদন ৬৬.২৬ ও রপ্তানি শূন্য দশমিক ৫৪ এবং ২০১২ সালে উৎপাদন ৬২.৫২ ও রপ্তানি ১.৫৬ মিলিয়ন কেজি ছিল। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে ২.৬৬ মিলিয়ন কেজি রপ্তানিই সবচেয়ে বড় পরিমাণ ছিল।

আরও পড়ুনঃ  করোনা ঠেকাতে ধর্মীয়প্রতিষ্ঠানে ৯ নির্দেশনা

চা-শিল্প দেশে সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। তবে সেই সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা হয়ে আছে চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়। দিনে ১২০ টাকা মজুরি থেকে ৩০০ টাকা উন্নীত করার দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়নি আজও। যে কারণে মাঝে মাঝেই শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। যা চা শিল্পের জন্য নেতিবাচক।

এ ব্যাপারে চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমরা বোর্ডের পক্ষ থেকে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে দাবি জানিয়েছি। শ্রমিকরা ভালো না থাকলে উৎপাদনেও সমস্যা তৈরি হবে।

চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ২০২৫ সালে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪০ মিলিয়ন কেজি। তখন দেশের ১২৫ মিলিয়ন কেজি চাহিদা পূরণ করে ১৫ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় আন্দোলনে শিল্পটির ক্ষতি হচ্ছে। এটি সবার জন্যই লোকসানের কারণ। শ্রমিকদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান চায় চা বোর্ড।

জানতে চেয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানকে পাওয়া যায়নি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন