- উৎপাদন কমেছে ১৭ ভাগ
ডিম সহজলভ্য ও জনপ্রিয় খাবার। ডিমকে পুষ্টি উপাদানের শক্তির উৎস বলা হয়। তাই প্রতিদিনের খাবার তালিকায় যাদের ডিম রয়েছে, তাদের ব্যয় আরও বাড়লো। বর্তমানে রাজধানীর বাজারগুলোতে ডিমের হালি ৫০ টাকা। তবে ১৩ দিন আগেও ডিমের হালি ছিল ৪০ টাকার নিচে।
মুরগির ফার্ম মালিকরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে ৮ টাকা থেকে ৮ দশমিক ২৫ টাকা। কিন্তু পাইকারি, খুচরা ও বিভিন্ন হাতবদলে পর সেই ডিম ক্রেতারা কিনছে ১২ দশমিক ৫০ টাকা দিয়ে। অবশ্য এলাকা ভেদে ডিমের দামের ভিন্নতা দেখা যায়।
দৈনিক তিন কোটি ডিমের (মুরগি) চাহিদা রয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ডা. এম এম খান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বর্তমানে ফার্মগুলো ২ কোটি ৫০ লাখ ডিম সরবরাহ করছে। সেই হিসেবে ডিমের ঘাটতি রয়েছে ৫০ লাখ। বর্তমানে পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে প্রতিটি লাল ডিম ৮ দশমিক ২৫ টাকা বিক্রি করছে। আর সাদা ডিম বিক্রি করছে ৭ টাকা।
ডিমের ঘাটতি প্রসঙ্গে ডা. এম এম খান বলেন, মুরগির খাবার মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আবার মুরগির বিভিন্ন রোগে কারণে উৎপাদনও ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া ফার্ম শ্রমিকদের বেতন, পরিবহনসহ অন্যান্য খরচও তো রয়েছে। সেই তুলনায় ডিমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না ফার্ম মালিকরা। লোকসানে পড়ে ও ভয়ে অনেক মালিক মুরগি বিক্রি করে ফার্ম বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে ফার্ম সংখ্যা কমেছে। এর কারণে ডিম উৎপাদন কমেছে প্রায় ১৭ ভাগ। যার প্রভাব পড়েছে বর্তমান ডিমবাজারে।
খুচরা বাজারে প্রতিটি লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২ টাকা ও সাদা ডিম সাড়ে ১১ টাকা জানিয়ে আরেক পোল্ট্রি ফার্ম মালিক নজরুল হাসান বলেন, অথচ আমরা লাল ডিম বিক্রি করছি সবোর্চ্চ ৮ টাকা ২৫ পয়সা। আর সাদা ডিম বিক্রি করছি ৭ টাকা। কিন্তু বাজারে সেই ডিম ক্রেতারা ৪ দশমিক ২৫ টাকা বেশি দামে কিনছে।
লাল ডিমের জনপ্রিয়তা বেশি জানিয়ে নজরুল হাসান বলেন, ফার্মের সাদা ডিমের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আগ্রহ কম থাকে। তাই বাজারের সাদার চেয়ে লাল ডিমের বিক্রি অনেক বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে দেশের ফার্মগুলো মোট ২ কোটি ৫০ লাখ মুরগির ডিম সরবরাহ করছে। ফার্মগুলো প্রতিটি লাল ডিম বিক্রি করছে ৮ দশমিক ২৫ টাকা। সেই একটি ডিম বিভিন্ন হাত ঘুরে ক্রেতারা কিনছে সাড়ে ১২ টাকায়। মানে ৪ দশমিক ২৫ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশি দাম গুনতে হচ্ছে।
আরও জানা যায়, প্রতিটি লাল ডিম সাড়ে ১২ টাকা হিসেবে আড়াই কোটি ডিমের দৈনিক বাজার দাম দাঁড়ায় ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফার্ম মালিকরা আড়াই কোটি ডিমের দৈনিক দাম পাচ্ছে ২০ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ী ও দুষ্ট চক্ররা (সিন্ডিকেট) মিলে ক্রেতাদের কাছ তুলে নিচ্ছে লাভ বাবদে দৈনিক ১০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে লাভ ও পরিবহন ব্যয় বাবদে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী নিচ্ছে ২ টাকা। বাকি ২ টাকা ২৫ পয়সা যাচ্ছে দুষ্ট চক্রের পকেটে।
সেই হিসেবে দুষ্ট চক্র ডিম বাবদে ক্রেতাদের পকেট কাটছে দৈনিক ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার ৫২৯ টাকা। গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর হু হু করে ডিমের দামে চড়া হয়ে পড়ে। সেই হিসেবে ১৩ দিন ডিমের বাজার চড়াও হয়ে আছে। তাতে ডিম বাবদে দৈনিক ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার ৫২৯ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দুষ্ট চক্রটি। আর ১৩ দিনে দুষ্ট চক্রটি ডিম ক্রেতাদের পকেট কেটেছে ৭৩ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার ৮৭৭ টাকা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) হালি দাম ৫০ টাকা। সেই হিসেবে একটি ডিমের দাম দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫০ টাকা। কিন্তু এলাকার ভেতরে মুদি দোকানগুলোতে অনেকেই ডিমের হালি ৫০ টাকাও ওপরেও বিক্রি হচ্ছে। তবে কয়েকদিন আগেও ডিমের হালি আরো চড়াও দামে বিক্রি হতো। জ্বালানি তেলের বৃদ্ধির ঘোষণার অজুহাত দেখিয়ে একটি চক্র দফায় দফায় বাড়িয়ে ডিমের হালি ৬০ টাকার ওপরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই চড়া দামের লাগাম পড়ে গত পাঁচদিনে। ফলে বর্তমানে ডিমের হালি ৫০ টাকা নিচে চলে এসেছে। এলাকাভেদে ডিমের দামের ভিন্নতা রয়েছে।
ডিমের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কথা হয় যাত্রবাড়ি ডিমের পাইকারি দোকানের ম্যানেজার আসাদ সঙ্গে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়া পর থেকেই ডিমের দাম চড়া। ওই সময় একশ ডিম ১২৫০ টাকার বেশিতে বিক্রি হয়েছিল। তবে গত পাঁচদিন ধরে ডিমের দাম কমছে। বর্তমানে একশ ডিম ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে একটি ডিমের দাম দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫০ টাকা। অবশ্য তেলের দাম বাড়ার আগে একশ ডিম নয়শ টাকার নিচে বিক্রি হতো।
ডিমের সরবরাহ কমেছে জানিয়ে আসাদ বলেন, বর্তমানে পোলট্রি খাবারের দাম অনেক বাড়তি। অনেকেই ফার্মের মুরগির খাবারের ব্যয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আবার দাম বাড়ায় অনেকেই ডিমপাড়া ফার্মের মুরগি বাজারে বিক্রি করছে। ফলে ডিম সরবরাহ ঘাটতির কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। তবে কয়েকদিন সরবরাহের চিত্রটা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ছে সামনে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
ডিমের বেচাকেনা কমে গেছে জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী খোকন বলেন, আড়ৎ থেকে দোকানে ডিম আনার পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। আবার পোলট্রির খাবারের সব কিছুই দাম বেড়েছে। এছাড়া ডিমের সরবরাহ কমেছে। সব মিলিয়ে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। তবে এখন কিছুটা কমা শুরু করছে। সরবরাহ বাড়লে ডিমের দাম আরো কমবে।
কথা হয় ডিম ক্রেতা আবিদের সাথে। তিনি বলেন, শনিআখড়া বাজার থেকে এক হালি ডিম কিনেছি ৫০ টাকা দিয়ে। তবে এলাকার ভেতরের দোকানে বিক্রি হচ্ছে কিছুটা বেশি দামে। গত সপ্তাহে এক হালি ডিম কিনেছি ৬০ টাকা দিয়ে। আরেক ক্রেতা কামরুন নাহার মেরী বলেন, বাড়ির সামনে দোকান থেকে এক হালি ডিম কিনেছি ৫২ টাকা দিয়ে। আট দিন আগে একই দোকান থেকে এক হালি ডিম কিনেছিলাম ৫৮ টাকা দিয়ে।
প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি করছি জানিয়ে মুদি দোকান সুমন হাওলাদার বলেন, প্রতি ডিম প্রায় ১২ দশমিক ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। কিছুদিন আগ ডিমের দাম আরো বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে সরবাহ বাড়ায় ডিমের দাম কমেছে।
ডিমের দাম বৃদ্ধি রোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলন চলছে। ডিমের দাম বাড়ার পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে নানান যুক্তি। তাদের মধ্যে মাইনুল ইসলাম রিফাত বলেন, মুরগির ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকেই ৭দিন ডিম কেনা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলছেন। আর তারা পরামর্শ দিচ্ছেন কিছুদিন ডিম খাওয়া বন্ধ রাখলেই ডিমের দাম কমবে, এমনটা কিন্তু নয়।
তারা বলছেন, এভাবে ডিম খাওয়া বন্ধ রাখলে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও ডিম উৎপাদন বন্ধ হবে। পরবর্তীতে ডিমের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সব মিলিয়ে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে মুরগির খাদ্য ও ওষুধের অধিক মূল্যবৃদ্ধি এবং যানবাহনের তেলের দাম বাড়ায় অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়া আদায়। খাদ্য, ওষুধ এবং তেলের দাম কমলেই কমবে ডিমের দাম এমনি ধারণা সাধারণ মানুষের।
উল্লেখ্য, একটি ডিমের বায়োলজিক্যাল ভ্যালু ৯৬। আদর্শ একটি ডিমের ওজন সাধারণত ৫০ গ্রাম। একটি ডিমে এনার্জি থাকে ১৪৩ ক্যালোরি। কার্বোহাইড্রেট থাকে দশমিক ৭২ গ্রাম। প্রোটিন থাকে ১২ দশমিক ৫৬ গ্রাম। ফ্যাট ৯ দশমিক ৫১ গ্রাম। এছাড়া ফসফরাস থাকে ১৯৮ মিলিগ্রাম। পটাশিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম। জিঙ্ক থাকে ১ দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম। এছাড়া আছে ভিটামিন এ ডি ই বি ১২, আয়রন, কোলেস্টেরল, কোলিন ইত্যাদি।
আনন্দবাজার/শহক