ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ঘিরে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে আগাম কোনো সতর্কতা ছাড়াই গত ৫ আগস্ট দেশে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ ও ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সরকার। এতে ডিজেল ও কেরোসিন লিটার প্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, অকটেন লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করা হয়। হঠাৎ এ দাম বাড়ার সময় বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে বাংলাদেশেও তা সমন্বয় করা হবে। তবে কয়েকদিন ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুবাতাস বইতে শুরু করলেও এখনও দেশে তার প্রভাব পড়েনি।
হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা সব পর্যায়েই। বিশেষ করে দেশে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে অযৌক্তিকভাবে। দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে যে ডিম ৪০ টাকা হালিতে বিক্রি হতো তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে ৫০ টাকা কেজির চাল হয়েছে ৫৫ টাকা। এমনকি ৫০ টাকার সবজিও কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা দরে।
অনেকেরই ভাষ্য, জ্বালানি তেলের ওপর ভর করেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার এই আস্ফালনে জীবন বাঁচানো নিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের হাপিত্যেশ বেড়েছে। যে কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার খবরে অনেকটা স্বস্তির হাওয়া পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের দাবি তুলেছেন সাধারণ মানুষ।
অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কয়েক দফায় কমে গেছে। গত মঙ্গলবারে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট- ডব্লিউটিআইয়ের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি (এক ব্যারেল ১৫৯ লিটার) ৮৬ দশমিক ১৩ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যা আগেরদিন সোমবারের তুলনায় ৩ দশমিক ২৮ ডলার বা ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। একই সময় ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ ডলার বা ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ কমে ৯২ দশমিক ১২ ডলারে নেমে এসেছে। যা গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন।
এদিকে, এরই মধ্যে বাংলাদেশে পরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। যদিও গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া থেকে কম দামে জ্বালানি কিনতে গিয়ে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তবে এখন ইমরানের সেই পথে অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে। ইতোমধ্যে চীন নিজস্ব অর্থে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। প্রতিবেশী ভারতও রাশিয়া থেকে নিজস্ব অর্থে কিনছে তেল। বাংলাদেশের সামনে এমন সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে রাশিয়া নিজেই। অবশ্য গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে নানা পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোসনেফ্ট অয়েল কোম্পানি গত সপ্তাহে বাংলাদেশে তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। দেশে অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের ক্ষমতা না থাকায় এ প্রস্তাব আসে রাশিয়া থেকে। বাংলাদেশ মূলত পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে থাকে কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ভারতসহ ৮টি দেশ থেকে। পরিশোধিত তেলের দাম এসঅ্যান্ডপি প্ল্যাটস এর রেটে নির্ধারিত হয়ে। ক্রুড অয়েলের দাম একটি নির্দিষ্ট সময়ে যত ডলার থাকে, তার সঙ্গে আরো ২০-২৪ ডলার যোগ করে নির্ধারণ করা হয় পরিশোধিত তেলের দাম। বর্তমানে ৩৫ শতাংশ কমে রাশিয়া থেকে চীন ও ভারত তেল আমদানি করছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে ডকুমেন্ট পেয়েছি। আমাদের শোধনাগারে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব নয়। কারণ এর ঘনত্ব মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের তুলনায় বেশি। ইআরএল রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করতে প্রযুক্তিগতভাবে অক্ষম। তাছাড়া ইআরএল প্ল্যান্টটি ৫৪ বছর পুরানো। রাশিয়ান তেল পরিশোধন করার জন্য এটি সাময়িকভাবে সংশোধন করা যাবে না। সংশোধন করলে পুরো প্ল্যান্টটি শৃঙ্খলার বাইরে চলে যেতে পারে।
এমডি লোকমান আরও বলেন, ইআরএলের জন্য উপযুক্ত কিনা তা আবার পরীক্ষা করতে তারা রাশিয়া থেকে তেলের নমুনা পেতে পারেন। স্থানীয় চাহিদা মেটাতে বার্ষিক ৪৫ লাখ টন পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০১০ সালে ইআরএল-এর দ্বিতীয় ইউনিট তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে এর প্রস্তাবটি অন্তত ১০ বার সংশোধন করা হলেও এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
সূত্রমতে, ১৯৬৮ সালে নির্মিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারির বার্ষিক সক্ষমতা প্রায় ১৫ লাখ টন। ইতোমধ্যে এই রিফাইনারিতে সৌদি আরামকো এবং ইউনাইটেড আরব থেকে আসা সাপ্লাই বুক এর করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, স্থানীয় শোধনাগারগুলোকে আপগ্রেড করার সম্ভাবনা যাচাই করতে শিগগিরই ঢাকা সফর করবে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের একটি দল। তিনি বলেন, আমরা যদি রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারি তাহলে তাদের থেকে ক্রুড অয়েলও কিনতে পারবো। ১৬ আগস্ট নির্দেশনা এসেছে, আমরা শিগগিরই প্রয়োজনীয় কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবো।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ছাড়াও আরো কিছু দেশের কাছ থেকে প্রস্তাব পাচ্ছি। তাদের এসব প্রস্তাবের শর্তাবলী কীভাবে পূরণ করা যায় তা দেখবো। এর আগে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম পরিশোধন করার ক্ষমতা না থাকায়।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে কবে নাগাদ জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা হবে এ বিষয়ে কথা বলতে জ্বালানি ও খনিজ সচিব মাহবুব হোসেন ও বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদকে ফোনে একাধিকবার কল করলেও পাওয়া যায়নি।