‘যদিও আমি যাইনি পরবাসে, তবু আমি
বিষণ্ন উদ্বাস্তু একজন। ক্লান্ত মনে ধরে ঘুণ, শুধু ঘুণ।’ (উদ্বাস্তু- শামসুর রাহমান)
কবির এই কবিতার লাইনগুলো যেন বর্তমান সময়ে বড় প্রাসঙ্গিক। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সময়ের সঙ্গে যেন বড্ড মিলে যায়। তবে এ মিলে যাওয়াটা মোটেই কাম্য নয়। স্বাধীনতার কবি, আধুনিকতার কবি শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর, ১৯২৯- ১৭ আগস্ট, ২০০৬) জন্মগ্রহণ করেছিলেন পুরাণ ঢাকার মাহুতটুলীর ৪৬ নম্বর বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস ছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মেঘনা পাড়ের পাড়াতলী গ্রামে। বাবা মুখলেছুর রহমান চৌধুরী ছিলেন পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ও মা আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। বাবা-মা ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। একটা সুস্থ ও সেকুলার পরিবেশে কেটেছে কবির শৈশব-কৈশোর।
‘হাজার হাজার লোক, এমনকি অসংখ্য কৃষক
আদি ভিটা জমিজমা ছেড়ে
খোঁজে ঠাঁই যেমন তেমন ভিনদেশে’। (শামসুর রাহমান)
এদেশের মানুষ কত রক্ত আর ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছিল, স্বপ্নের কাজল মেখেছিল দুচোখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন আজো অনেকটা স্বপ্নই থেকে গেল। কবির পংক্তিমালায় কত নিখুঁতভাবে সেই আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯৫৫ সালে জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিক হিসেবে। ১৯৫৭-৫৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক। ১৯৬০-৬৪ পর্যন্ত ছিলেন ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’র সিনিয়র সহসম্পাদক। ১৯৬৪-৭৭ পর্যন্ত ‘দৈনিক পকিস্তান’/ ‘দৈনিক বাংলা’য় সহকারী সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৭৭-৮৭ পর্যন্ত ‘দৈনিক বাংলা’য় ও ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শামসুর রাহমান প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন কবি। প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। তাঁর কবিতা প্রেরণা দিয়েছে এ দেশের মানুষকে। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’য় লিখেছেন-
‘উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। ’
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কবি লেখেন-
‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া
থরে থরে রে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে।
কখনো মিছিলে কখনো বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহীদের কলুষিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।’
স্বাধীনতা সম্পর্কিত তার কবিতা দারুণ দাগ কাটে পাঠক হৃদয়ে।
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
-নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা।)
শামসুর রাহমানের কবিতার রোমান্টিকতা ধরা দিয়েছে ভিন্নরূপে। ‘প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রমাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘তুমি বারবার বলো ঘুরে ফিরে সেই একই কথা
তাহলে প্রমাণ দাও, সত্যি ভালোবাসো কি না।’
শামসুর রাহমানের ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম বিবেচনাবোধ আর প্রখর সমাজ চেতনা। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ আর বাস্তব নির্মমতা তার কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কবির ‘সুধাংশু যাবে না, ধ্বংসের কিনারে বসে, কবিতায় মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে এভাবে-
‘লুণ্ঠিত মন্দির আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী সুর সুধাংশু কে ছুঁলো-
বেলাশেষে সুধাংশু ভস্মের মাঝে
খুঁজে বেড়ায় দলিল ,ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের কৌটো
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুতিমালা।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।’
জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো দারুণভাবে কবির মনে রেখাপাত করত। সমসাময়িক সমাজের দুঃখ বেদনা হাসি কান্না তার কবিতায় উঠে এসেছে অবলীলায়। বর্তমান সমাজে, রাষ্ট্রে যে অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সম্প্রীতির বন্ধনকে আলগা করে দিচ্ছে অনেকখানি কবি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন সেই সময়ে। সত্য প্রকাশের অবিচল ধারায় চলতে গিয়ে নিজেও মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন কবি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ