- দিয়েছিলেন সবুজ বিপ্লবের ডাক
- তার চোখে উন্নয়নের বাধা ছিল দুর্নীতি
জাতির পিতা বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দর্শন এখনো পথ দেখাচ্ছে। তিনি যে লড়াকু মনোভাব উপহার দিয়েছেন তা দিয়ে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। কেননা তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরে মাথাপিছু আয় ১৭৯ দশমিক ৭৩ মার্কিন ডলার বাড়িয়েছিলেন। যার সমান হতে পরবর্তীতে ১৩ বছর লেগেছিল। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের।
‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি ও বাণিজ্য ভাবনা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, যুদ্ধোত্তর বাস্তবতার নিরিখে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭৩-৭৮) মূলকথা। সেখানে কৃষি ও শিল্পকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়। কেননা এটিই ছিল কর্মসংস্থান ও দারিদ্র নিরসনের হাতিয়ার। এ জন্য কৃষিতে ২৪ ও শিল্পে ২০ শতাংশ সম্পদ বিনিয়োগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন তুলে ধরে ড. আতিউর আরও বলেন, যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসনের তাগিদে জাতির পিতা অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন পরিবহন, জ্বালানি, অবকাঠামো ও গৃহায়নকে। সেক্ষেত্রে জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদে বিনিয়োগ ছিল ১২ শতাংশ। আর ভৌত পরিকল্পনা ও গৃহায়ন ছিল ১০ শতাংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সামাজিকখাতে উল্লেখয়োগ্য বরাদ্দ রেখেছিলেন পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে বেগবান ও অন্তর্ভূক্তিমূলক করতে। এ জন্য স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণে বিনিয়োগ ছিল ৫, শিক্ষা ও মানবসম্পদে ৭ শতাংশ।
কৃষিকে কর্মসংস্থান, দারিদ্রমুক্তির উপায় ও শিল্পবিকাশের পেছনের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ শিল্পের কাঁচামালের সরবরাহ, শিল্পপণ্যের চাহিদা তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা। এজন্য ২২ লাখ কৃষকপরিবারের পুনর্বাসন ও এক লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। চার মিলিয়ন ডলার কৃষিঋণ দিয়ে কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য ও রেশন সুবিধা দেন বঙ্গবন্ধু। কৃষি গবেষণাতেও গুরুত্বারোপ করেন। এ জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরই) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা সংস্থা (বিআরআরই) প্রতিষ্ঠা করেন।
বঙ্গবন্ধু কৃষিগ্রাজুয়েটদের সিভিল সার্ভিসে সংযুক্ত করেছিলেন। কৃষির অন্যতম শক্তি সেচসুবিধা। এজন্য তিনি ৪৩ হাজার সেচযন্ত্র প্রদান করেন। এতে ১৯৭৫ সালেই ৩৩ শতাংশ সেচের আওতা বৃদ্ধি পায়। রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় ৭০ শতাংশ। এমনকি উন্নত বীজের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় ২৫ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কৃষিখাতে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি ছিল ৪৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
শুধু তাই নয়, দুর্নীতিকে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বলেছিলেন, করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজ ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করছি। আজ যেখানে যাবেন করাপশন দেখবেন। আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন, খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পার্সেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই বক্তৃতা করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে ড. আতিউর বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি মাথাপিছু আয়কে ২৭২ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেন। যা ১৯৭২ সালের আগে ছিল ৯৩ দশমিক শূন্য ২ মার্কিন ডলার। ১৯৭৩ সালে হয় ১১৭ দশমিক ৭৩ ও ১৯৭৪ সালে ১৭৯ দশমিক শূন্য ৫ মার্কিন ডলার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে শহিদ করার পর মাথাপিছু আয় নেমে আসে ১৯৭৬ সালে ১৩৮ দশমিক ৫৯ ও ১৯৭৭ সালে ১২৮ দশমিক ৮১ মার্কিন ডলার। আর সেই ২৭২ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারের সমান হতে সময় লেগেছিল ১৩ বছর।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ শেষ করতে স্বায়ত্ত্বশাসনকে সামনে এনে ছয়দফা দিয়েছিলেন। সেখানে ছিল- ১. পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র, ২. কেন্দ্রের ক্ষমতা কেবল দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে সীমাবন্ধতা, ৩. পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য আলাদা কিন্তু বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করা, ৪. কর ও শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যের কাছে ন্যস্ত থাকা, ৫. প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাব আলাদা করা ও ৬. পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠন।
অর্থাৎ এই ছয় দফায় ৩টিই অর্থনৈতিক। কারাগারের রোজনামচার ১৬৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লেখেন, ১৯৬৬-৬৭ সালের আমদানি নীতি পড়লাম, বোঝা গেল প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণ টিকে থাকতে পারবেন না। পূর্ব-পাকিস্তানিরা যা-ও দুইএকজন কিছু কিছু আমদানি করতো, তারাও শেষ হয়ে যেতে বাধ্য হবে। বৃহৎ ব্যবসায়ীগ্রুপ অবাধ আমদানি নীতির এই সুযোগে বাজার-ব্যাংকসমূহের সহায়তায় যথেষ্ট পরিমাণ আমদানি করে বাজার থেকে ক্ষুদ্র আমদানিকারকগণকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে।
তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের করনীতির সমালোচনায় বইটিতে জাতির পিতা লেখেন, দেশের গরিরের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই আজ বড় বড় প্রাসাদ হচ্ছে। আর তারা দু’বেলা ভাত পায় না। লেখাপড়া, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থা ছেড়েই দিলাম। বন্যায় শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাইতেছে প্রত্যেক বৎসর। সেদিকে কারও কোনো কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানি বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা হ্রাস ৬২ শতাংশ হতে ২৭ শতাংশে নামিয়ে আনেন। নিত্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করেন।
শিল্পায়নের কৌশলে তিনি রাষ্ট্র-নির্ভরতা থেকে ব্যক্তিখাতে বিকাশ করেন। শুরুতেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিল্পের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেন। এক্ষেত্রে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যক্তিখাতের কার্যকর বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টির প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনায় স্থান দেন। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের সীমিত ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটিতে নেয়া এবং ১৩৩টি পরিত্যক্ত কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করেন।
সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আপসহীন অভিযাত্রার অংশ। সেখানে ১. দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা, ২. বিকেন্দ্রায়িত সরকার, ৩. উন্নয়নে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ, ৪. দেশব্যাপী সমবায় আন্দোলন। আর এর ফলাফল হলো টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।
মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির সমন্বয় ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। এজন্য স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর মুদ্রা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে গ্রেট ব্রিটেন থেকে উন্নতমানের নোট ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে বাজারে নকল নোট ছড়িয়েপড়া ঠেকানো সম্ভব হয়। তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একশ টাকার নোট ‘ডিমনিটাইজ’ করার সিদ্ধান্ত নেন, (যা গভর্নর ছাড়া আর কেউ জানতেন না)। এবং বৈদেশিক মুদ্রা (পাউন্ড স্টার্লিং) এর সাথে টাকার বিনিময় হার নমনীয় করেন যাতে বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দেয়া যায়।
দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণায় ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু সুদিনের আশায় বলেন, এই দিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক। যদি ডেভেলপ করতে পারি, ইনশা-আল্লাহ এদিন থাকবে না। তোমরা আজকে সুযোগ পেয়ে জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে দাও। জিনিসের দাম বাড়িয়ে দাও। আর তাই আমাদের কিনতে হয়। আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না…।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. আতিউর রহমান বলেন, বর্তমান সংকট নিরসনেও পথ দেখাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন। কেননা নেতৃত্বের একটি পরমপরা আছে। তাঁর সেই পথেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ দেশের চেয়ে ভালো করছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি লড়াকু মন দিয়ে গেছেন। সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি। সেই পুঁজি ব্যবহার করেই এই সংকট থেকে সফল হওয়া সম্ভব।
আনন্দবাজার/শহক