টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে জন্ম নেয়া মা বাবার আদরের খোকা, পাড়া প্রতিবেশীর মুজিব ভাই বাঙালির বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক জীবন ছিল গৌরবময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং স্নেহ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। রাজনৈতিক জীবনের চলার পথে বাবার শাসনের পাশাপাশি পেয়েছেন সমর্থন ও সহযোগিতা। পেয়েছেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসার প্রেম ভালোবাসা সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।
ইসলাম প্রচার করতে এসে শেখ পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা পরবর্তীতে ব্যবসা বাণিজ্যে অগ্রগতি লাভ করে এবং খ্যাতি অর্জন করে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শেখ পরিবারের রয়েছে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের আপোষহীন সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটা স্বাধীন ভূখণ্ড।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। দু’মেয়ের পর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হওয়ায় মা সায়েরা খাতুন খুব খুশি হয়েছিলেন। শেখ পরিবার ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে পারিবারিক বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফুর রহমান চাচাত বোন সায়েরা খতুনকে বিয়ে করেছিলেন। দশ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার তিন বছরের চাচাত বোন ফজিলাতুন্নেসা রেণুর বিয়ে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব কৈশোরে মা-বাবার আদর শাসন ও পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসায়। মার চিন্তা ছিল তার আদরের রোগা ছিপছিপে খোকা কবে বড় হবে? বাবার চিন্তা ছিল কীভাবে তার ছেলে একজন আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে। টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে কেটেছে শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব। গ্রামের মানুষদের সহজ সরল জীবন তাকে আকৃষ্ট করতো। তখন থেকেই শেখ মুজিব দূঃখী মানুষের কথা ভাবতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন একজন বুদ্ধিমতি ধৈর্য্যশীল এবং সাহসী নারী। ফজিলাতুন্নেসা তিনবছর বয়সে পিতা এবং পাঁচবছর বয়সে মাতাকে হারালে শেখ মুজিব ও তার ভাই বোনদের সাথে একই পরিবারে বড় হয়। ছোট বেলার খেলার সাথী ফজিলাতুন্নেসা রেণু হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী। যখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ১৯ এবং রেণুর বয়স ১০ বছর তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়েছিল।
খেলার সাথী রেণু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকে করতে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল দারুণভাবে। স্বামীর রাজনীতি, সংগ্রাম, কারাবরণ, মামলা পরিচালনা, পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা সবই করেছেন দক্ষতা ও সাহসের সাথে। নিজ বাড়িতে সভা করা এবং নেতাদের নিজে রান্না করে নিজ হাতে পরিবেশন করতেন ফজিলাতুন্নেসা। কারাবরণকারী নেতা কর্মীদের সাহায্য করতেন। কারাবন্দি স্বামীর সাথে যখন দেখা করতে যেতেন তখন পরামর্শ দিতেন, বাইরের খবরাখবর পৌঁছে দিতেন এবং তার নির্দেশ নেতা কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
চল্লিশ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মুজিবের নেতা হয়ে ওঠার সময়টাতে স্ত্রীর সতর্ক দৃষ্টি ও ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি। ছয় দফা আন্দোলনের সময় ফজিলাতুন্নেসা নিজের অলংকার বিক্রি করে সংগঠনের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, সংসার চালানো ও মামলা চালাতে অলংকার বিক্রি করেছেন বেগম মুজিব। স্বামীর জন্য অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন কিন্তু কখনো কোনো অভিযোগ করেননি। নিজের সম্পদ বিক্রি করে ঢাকায় বাড়ি করেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেগম মুজিব পরামর্শ দিতেন। রাজনীতির কারণে মুজিবের পরিবারকে অনেক নিগৃহীত হতে হয়েছে। ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া নিতে ও থাকতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। একা সব সামলেছেন ফজিলাতুন্নেসা শক্ত হাতে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং সামরিক আদালতে গোপন বিচার করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে তখন।
ঢাকা শহরে কেউ তাদের বাসাভাড়া পর্যন্ত দিতে চায়নি পাক সেনাদের ভয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩২নং বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ১৮নং রোডের একটি বাড়িতে বন্দি রাখে মুজিব পরিবারকে। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা পারিবারিক সংহতি মজবুত করে। বেগম মুজিব নিজ হাতে খাবার তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। বঙ্গবন্ধুও স্ত্রীকে ভালোবাসতেন।
৭ মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে বেগম মুজিব শেখ মুজিবুর রহমানকে বলছিলেন- তোমার যা মন চায় তুমি তাই বলবে। তোমার চেয়ে বাংলার মানুষ কে ভালো জানে? কত নেতা কত স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছেন, মুজিব এসব অনুসরণ করেন নি। স্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নিজের মনের কথাগুলো বলেছিলেন নিজের মতো করে। আর সে কারণেই সে ভাষণ হয়েছে বিশ্বনন্দিত।
অমানিশার কাল পেরিয়ে সোনালি সূর্য উঠেছে। অনেক প্রাণ আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। মুজিব মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে মা-বাবা ও স্ত্রী সন্তানদের ভালোবাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। পারিবারিক সুখ ও শান্তিই ছিল তার সকল সংগ্রামের অনুপ্রেরণা ও সাহস। তার বাবা মা তার রাজনীতির গর্ব করতেন। তার পরিবার ছিল বাঙালি মনে প্রাণে এবং অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বড়িতে ছিল না দামি কোন আসবাবপত্র। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মম ভাবে নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন- ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল,ব সেইতো আছো, লেখ তোমার জীবন কাহিনী।’ বঙ্গবন্ধু খাতা নিয়ে লেখা শুরু করতে গিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাতেই লিখেছেন- ‘আমার স্ত্রী তার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেণু আরও একদিন জেলগেটে আমকে অনুরোধ করেছিল তাই লিখতে শুরু করলাম।’ স্ত্রীর প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে অকপটে জীবন কথা লেখার শুরুতেই স্ত্রীর অনুরোধ মেনে চলার স্বীকৃতি দেয়া যায় বঙ্গবন্ধু তার প্রমাণ।
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘রেণু খুব কষ্ট করতো, কিন্তু কিছুই বলতো না, নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিবারের সদস্যদের সুখের জন্য সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে ৩০৫৩ দিন বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায় নি কখনো।
দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কারাগারে থাকলেও তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার কোনো অভাব ছিল না। খুব অল্প পেয়েই তারা খুশি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের দাম্পত্য জীবন, তাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত অণুসরণ করলে যেকোনো সংসারে সুখের সুখের ফল্গুধারা বইবে নিশ্চিত। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের যে মহান ত্যাগ, সে ত্যাগের সম্মান দেয়াটা আমাদের কর্তব্য।