প্রতিশ্রুতিকে আইনিভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে
- শিক্ষায় ১০ প্রতিশ্রুতির ৬টিই অনির্দিষ্ট: মুনতাসির কামাল
- কর্মসংস্থানের ১৬ বিশেষ প্রকল্পের ৭টিই বাস্তবায়নে বাকি: রাতিয়া রেহনুমা
বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে ইশতেহার ঘোষণা করে থাকে। এসব ইশতেহারের যদিও আইনি কোনো কাঠামো নেই তারপরও এটিতে মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ইশতেহার দিয়েই ভোট সংগ্রহ করে থাকে। সেজন্য এটিকে অবশ্যই আইনিভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তবে আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে যে ইশতেহার দিয়েছিল তার মধ্যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও জেন্ডার সমতা বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির আয়োজনে এবং জাতিসংঘ ডেমোক্রেসি ফান্ড (ইউএনডিইএফ)-এর সহযোগিতায়, ‘জাতীয় উন্নয়নে অঙ্গীকার: শিক্ষা, মানসম্মত কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা’ শীর্ষক দিনব্যাপী সম্মেলনে বিভিন্ন প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে আসে। গতকাল শনিবার রাজধানী ঢাকার গুলশানের লেকশোর হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নান, এমপি। সকাল ১০টা থেকে শুরু সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোট চারটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় এম এ মান্নান বলেন, নিম্ন-আয়ের মানুষ ভিজিএফ কার্ড চায়, টিউবওয়েল ও স্যানিটেশন চায়। তবে এখন বিদ্যুৎ চায় না যদিও আগে সবাই চায়তো। এখন সরকার এটি সবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। তা ছাড়া সবাই কাজ চায়, কাজের সুযোগ চায়। কেননা তারা কাজ করে খেতে চায়। সামাজিক সুরক্ষার জন্য কাজ চায় মানুষ। তিনি বলেন, জাতীয় ইশতেহারের (দলভিত্তিক ইশতিহার) সাথে নিজস্ব কিছু ইশতিহার দেয়া হয় স্থানীয়ভাবে। সাধারণ মানুষকে খুশি করতে। এসবের মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন। উঠান বৈঠকের গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এটি সংস্কৃতির অংশ। তফসিলদার ও ইউপির সচিবরা ক্ষমতাবান ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে স্থানীয় উন্নয়নে এগুলো খুবই শক্তিশালী। আমাদের বাল্যবিয়ে জাতির জন্য কলঙ্ক।
এম এ মান্নান বলেন, বিশ্ব সমুদ্রে ঢেউয়ের স্রোত আমাদের পুকুরেও আঘাত হেনেছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী কৃচ্ছ্রতা নীতিতে অগ্রসর হচ্ছেন। ভোটাররা স্থিতিশীলতা, কাজের পরিবেশ ও শান্তি চায়।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইশতিহার প্রকাশ করেছিল। সেখানে ৪টি মাইলফলক নির্ধারণ করা হয়। ১. ২০২১ সালের আগেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, ২. ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি বাস্তবায়ন’ অর্জন, ৩. ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ ও ৪. ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ তথা ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়া। এ ছাড়াও ৩৩টি খাতে জোর দেয়া হয় বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মূল প্রবন্ধে বলা হয়। তিনি “শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা: অর্জন কতটুকু?” শীর্ষক প্রবন্ধে এসব কথা বলেন।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মানসম্মত কর্মসংস্থান বিষয়ে ইশতিহারে ৪৬টি অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সেখানে ২৪টি প্রতিশ্রুতি (৫২ শতাংশ) সুনির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। এই ইশতেহারে মানসম্মত কর্মসংস্থান বিষয়ক অঙ্গীকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের ইশতেহারের তুলনায় শ্রম অধিকার ও নারী-পুরুষ সমতায় জোর দেয়া হয়েছিল। সেখানে ৬০টি প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তারমধ্যে ২৪টি মানসম্মত কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার ছিল যা লক্ষ্যভিত্তিক হিসেবে ৪০ শতাংশ। তাছাড়া ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার কম ছিল। কেননা ২০০৮ সালে ছিল ৫৪ শতাংশ ও ২০১৪ সালে তা ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ।
বর্তমান ইশতেহারে ২০২৩ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার ১.২ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কৃষি, শিল্প ও সেবা কর্মসংস্থানে চাকরির হার যথাক্রমে ৩০, ২৫ ও ৪৫ শতাংশ হবে। অর্থাৎ এই সময়ে এক কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার মানুষকে নতুন কর্মসংস্থানে যুক্ত করা হবে।
সিপিডির গবেষণা সহযোগী রাতিয়া রেহনুমা মানসম্মত কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রবন্ধে বলেন, কর্মসংস্থানের সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে রয়েছে দেশ। কেননা আইএলওর হিসেবে ২০২১ সালে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ছিল ৫.২ ও যুব বেকারত্ব ১১ শতাংশ। আর আইএলও ও এডিবির ২০২০ সালের প্রক্কলন অনুযায়ী ২০২০ সালে তা প্রায় ২৫ শতাংশ হতে পারতো, যা ২০১৯ সালে ছিল ১১.৯ শতাংশ। যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে ‘শেখ জামাল উপজেলা যুব প্রশিক্ষণ ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’ হাতে নেয়া হয়েছে। তাতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। তিনশটি জায়গায় তরুণ কর্মসংস্থান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিটি উপজেলা থেকে এক হাজার যুবককে বিদেশে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে তিনি জানান, ২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী ৬৪ জেলা থেকে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৮৪জন শ্রমিক বিদেশে কর্মরত আছে। তা ছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নিজস্ব তহবিল থেকে বছরে ৪০ হাজার যুবককে ১৪৬ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। কর্মসংস্থান বিষয়ে ১৬টি বিশেষ প্রকল্পের মধ্যে ৭টিই বাস্তবায়নে বাকি রয়েছে।
জেন্টার সমতার বিষয়ে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চশিক্ষায় নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত বর্তমানের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশে উন্নীত করা। এটি এসডিজিতে ৫.১ এ রাখা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসেবে ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৬২ শতাংশ ছাত্র ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ৭১ শতাংশ। ডিগ্রিতে ছাত্রীর হার ৪৩.৮০ ও স্নাতকোত্তরে ৩৭.৭৭ শতাংশ। ইশতেহারে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তাদের জন্য আলাদা ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ সুবিধা, কারিগরি সুবিধা ও সুপারিশসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। এটি এসডিজিতে ৫.ক এ রাখা হয়েছে।
সিপিডির গবেষণা সহযোগী সৈয়দ ইউসুফ সাদাত জেন্ডার সমতা বিষয়ক প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই উন্নয়ন নীতি বিভাগ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানত ছাড়া সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এসএমই ঋণ দেয়া, দেশের ৬৪ জেলার ৪৯০ উপজেলায় প্রায় এক কোটি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আওতায় আনা হচ্ছে। নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ৬৪ জেলায় ৪৮৮টি উপজেলায় জনপ্রতি ৫০০০ থেকে ১৫০০০ টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া, ২০২১ সালে এসএমই ফাউন্ডেশনে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ২০৯৩.৯২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আলাদা হেল্প ডেস্ক স্থাপন, বাংলাদেশ ব্যাংক শিল্পপ্লটে ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তহবিলে ১০ শতাংশ করে কোটা দেয়া হয়েছে। তবে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে দেশের ৭৭ শতাংশ কর্মস্থলে এখনো নারীকর্মীদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই। তবে সরকারি উদ্যোগে মাত্র ২০টি দিবা যত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। তিনি জানান, জেন্ডার সমতার ৫টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে ২টি বাস্তবায়নে বাকি, একটি মন্থর।
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১৮ সালের ইশতিহারে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে যোগ্যতা, মেধা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ে কথা বলা হয়। শিক্ষকদের বেতন এবং মর্যাদ বৃদ্ধিসহ সকল কল্যাণমূলক উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়েন শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে কিছু বৈষম্য থাকতে পারে, যা পরবর্তী মেয়াদে বিবেচনা করা হবে।
সিপিডির রিচার্স ফেলো মুনতাসির কামাল তার প্রবন্ধে জানান, ২০২০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাক্ষরতার হার ছিল ৭৫.৬ শতাংশ। ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে ঝরেপড়ার এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.২ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ৩৯.৮ শতাংশ। প্রাথমিকে ঝরেপড়া হ্রাস ও উপস্থিতি বাড়াতে ২০১৯ সালে জাতীয় স্কুল মিল পলিসি অনুমোদন দেয়া হয়। এ জন্য বছরে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে খাবার দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ‘ডিজিটাল এক্সিসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম’ নামে বিশেষ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়াও এটুআই প্রোগ্রাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহযোগিতায় প্রথম হতে ১০ম শ্রেণিতে অধ্যায়নতরত সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে মুদ্রণ প্রতিবন্ধী ও শিক্ষাপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ৯১৯৬টি ব্রেইল বই দেয়া হয়েছে। মুনতাসির কামাল জানান, শিক্ষায় ১০টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে ৬টিই অনির্দিষ্ট।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইশতেহার এক বছর আগে থেকে আলোচনা হতে হবে। নির্বাচনের আগে তা নির্ধারণ হবে। এখন এমপিরা শুধু মুখ নয় হাত-পা চালানো শুরু করেছেন। আর এটি শিক্ষকদের উপর বেশি হচ্ছে। সরকারি গাড়ির জ্বালানি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে তা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নেই। শিক্ষা নিয়ে বলেন, শিক্ষার বরাদ্দ অশিক্ষায় চলে যাচ্ছে। বরাদ্দ যা আছে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য বিষয়ে বলেন, প্রাথমিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষকরা ভালো থাকলেও দেশের ৯০ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভালো নেই। তাদের জন্য কিছু করা দরকার।