দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখ চা শিল্প ঘন ঘন লোডশেডিং আর শ্রমিক আন্দোলনে দুর্দিনে পড়েছে। গতকাল শনিবার থেকে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির মাধ্যমে আন্দোলনে নেমেছেন সারা দেশের চা শ্রমিকরা। সিলেটে শ্রমিকরা রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পাশাপাশি সড়কও অবরোধ করেছেন। বর্তমান মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবিতে তাদের এই আন্দোলন। এর ফলে সকল চা বাগানে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
অপরদিকে, গত কয়েকদিনের ঘন ঘন লোডশেডিং ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে চা উৎপাদনে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় হুমকির মুখে পড়েছে দেশের চা শিল্প। দেশে নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগানের মাঝে বৃহত্তর সিলেটেই ১৩৫টি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১, হবিগঞ্জে ২৫ ও সিলেটে ১৯টি। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ২২, পঞ্চগড় জেলায় ৭, রাঙামাটিতে ২ এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান রয়েছে। দেশের সব চা বাগানে গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে সিলেটসহ সারাদেশেই চা শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছেন।
বেলা ১১টার দিকে সিলেটের লাক্কাতুরা, মালনিছড়া, খাদিম, কেওয়াছড়া, দলদলি, জাফলং, লালাখালসহ বিভিন্ন বাগান ঘুরে জানা যায়, আন্দোলনরত শ্রমিকরা সকাল থেকে বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বেলা ১১টার দিকে শ্রমিকরা বিমানবন্দর সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন। প্রায় আধাঘন্টা ছিল তাদের অবরোধ। এতে সড়কের উভয়পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে বিদেশগামী যাত্রীরা পড়েন সংকটের মধ্যে। ফ্লাইট মিস করার দুশ্চিন্তা ছিল তাদের চোখেমুখে। তবে প্রায় আধাঘণ্টা পর চা শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে যান। পরে তারা মিছিল সহকারে সিলেট নগরীর দিকে এগোতে থাকেন।
দুপুরে শ্রমিকরা নগরীর চৌহাট্টায় এসে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এসময় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আমরা গত ৮ আগস্ট থেকে আন্দোলন করে আসছি। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের দাবি দাওয়া নিয়ে গত বৃহস্পতিবার চা বাগানগুলোর মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করে বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তর। মালিকপক্ষের কেউ বৈঠকে আসেননি। এতে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। ফলে শনিবার সকাল ছয়টা থেকে দেশের সবগুলো চা বাগানের শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন।
রাজু গোয়ালাও আরও বলেন, ‘৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ও আন্দোলন চলবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার বা চা-বাগান মালিকপক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস পাইনি। প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন থেকে সরবো না।’ কয়েকজন চা শ্রমিক প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কী হয়? মালিকপক্ষ বলে, তারা শ্রমিকদের রেশন দেয়। কী রেশন দেয়? শুধু আটা দেয়। আমাদের এগ্রিমেন্টে বলা আছে- ছয় মাস চাল, ছয় মাস আটা দেবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি রাখেন না। দাবিকৃত মজুরিটা আমাদের বাঁচার জন্য দরকার।’
সূত্রমতে, চা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রম আইন অনুসারে চা শ্রমিকদের পক্ষে দরকষাকষি করে এই সংগঠন। সম্প্রতি চা-বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনয়ায় শ্রমিক ইউনিয়ন চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বোনাস প্রদান, ছুটিসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। পরবর্তীতে মালিকপক্ষ মজুরি ১৪ টাকা বাড়নোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু চা শ্রমিকরা এই মজুরি বৃদ্ধিকে ‘পরিহাস’ বলে মনে করছেন।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা জানান, গত ১ আগস্ট চা শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী কমিটি ও ভ্যালি কমিটিসমূহের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে চা সংসদে স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। গত ৩ আগস্ট সেই স্মারকলিপি প্রদান করে চা শ্রমিক ইউনিয়ন। সেখানে সাতদিনের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে ‘গ্রহণযোগ্য সুরাহার’ দাবি জানানো হয়। অন্যথায় আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। আলটিমেটামের পর মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় গত মঙ্গলবার থেকে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেন চা শ্রমিকরা।
প্রথম চারদিন ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালনের পর গতকাল শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির মধ্য দিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন সারা দেশের চা শ্রমিকরা। গতকাল বিকাল পর্যন্ত সিলেটে বিভিন্ন চা বাগানের পাশের সড়কের দ্বারে অবস্থান নিয়ে চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। এসময় পর্যন্তও সংশ্লিষ্টরা আশ্বাসের বার্তা নিয়ে আসেননি বলে শ্রমিকরা জানান।
অপরকিকে, দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং চালু হওয়ার কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের চা শিল্প। সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে লোডশেডিং আরো বাড়ছে। লোডশেডিং এখন দিনে ৮-১০ ঘণ্টা স্থায়ী হচ্ছে। এতে উৎপাদন হ্রাসের শঙ্কায় রয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে- চা পাতা উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই স্পর্শকাতর। এই প্রক্রিয়া কোনো কারণে থেমে গেলে ওই পাতা নষ্ট হয়ে যায়। অথবা এর মান নষ্ট হয়ে যায়। এখন চায়ের ভরা মৌসুম। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চায়ের উৎপাদন। শঙ্কা দেখা দিয়েছে চায়ের গুণগত মান রক্ষা নিয়েও। এর প্রভাব পড়বে চা রপ্তানি বাজারেও। চায়ের মান খারাপ হলে রপ্তানিও করা যাবে না। আবার রপ্তানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কাও থাকবে। এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে।
বিভিন্ন বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা জেনারেটর চালিয়েও চায়ের কারখানাগুলো আর সচল রাখতে পারবে না। জ্বালানি সংকট ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এটা সম্ভব হবে না।
চায়ের রাজধানী খ্যাত সিলেট বিভাগের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় মৌলভীবাজার জেলায়। সারা দেশের মোট ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলাতেই রয়েছে ৯২টি। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় এখানকার চা। তবে হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের কারণে সংকটে পড়েছে এই চা শিল্প।
চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ করে লোডশেডিং তীব্র হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এই সময় প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ থেকে ৭০ হাজার কেজি চা-পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে এই কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যায় পড়ছে বাগান কর্তৃপক্ষ। দিনে বার বার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ার কারণে ব্যবহার করতে হচ্ছে জেনারেটর, আর তাতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এর মধ্যে সরকার জ্বালানি তেলের বাড়ানোয় খরচ আরও বেড়ে গেছে।
মৌলভীবাজারের রাজনগরের মাথিউরা, চানভাগ ও ইটা চা-বাগান কর্র্তৃপক্ষ বলছে, লোডশেডিংয়ের কারণে তারা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে তাদের জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। আর জেনারেটর চালানোর জ্বালানির ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। অন্যদিকে পেট্রোল সরবরাহও পর্যন্ত নয়। যে কারণে জেনারেটার চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
বাগান মালিকরা বলছেন, এখন চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এই মুহূর্তে যে বাগানে চা পাতা একেবারেই কম তাদেরও ৯/১০ হাজার কেজি পাতা আসে ফ্যাক্টরিতে। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণেই ২৪ ঘণ্টা কারখানা চালু রাখতে হয়। কিন্তু একটানা ১২ ঘণ্টা ফ্যাক্টরি চালানো যাচ্ছে না। সময়ে অসময়ে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের দুই ঘণ্টা থাকছে না।
একটানা যদি ফ্যাক্টরি না চলে তাহলে চায়ের গুণগত মান নষ্ট হয়। চা উৎপাদনে ৪ থেকে ৫টি ধাপে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে যদি ১টা ধাপে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তারা আরও বলেন, বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের পর থেকেই বিদ্যুতের প্রয়োজন। এই কাঁচা পাতা ফ্যান চালিয়ে একটানা ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা টার্ফে রাখতে হয়। তারপর মেশিনে তুলতে হয়। তখন যদি একঘণ্টা চলার পর মেশিন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পাতা মেশিনে আটকে নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, এখন চা উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বিদ্যুতে সমস্যার কারণে আমাদের সবগুলো বাগানেই চা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সকল যন্ত্রপাতি আবার অনেক সময় জেনারেটরে চালানো সম্ভব হয় না। চা উৎপাদন প্রক্রিয়াটা খুবই স্পর্শকাতর। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে হয় পাতার মান নষ্ট হবে, না হলে পাতায় ভাপ ধরে নষ্ট হবে।
এদিকে বাংলাদেশ চা বোর্ডের বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছর দেশে মোট চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ বিলিয়ন কেজি। কিন্তু লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।