ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু-যুদ্ধের থাবায় চাল

জলবায়ু-যুদ্ধের থাবায় চাল

চাল আগুনে সিদ্ধ হয়ে ভাতে পরিণত হয়ে পেটের ক্ষুধা নির্বারণ করলেও সেটি হয়তো আর হচ্ছে না। কেননা সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগুন চালকেও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। চাল নিজে জ্বলে অন্যকে প্রশান্তি দিতে পারবে না দেশ ও বিশ্ববাজারের কারণেও। বাংলাদেশে তো কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বাড়ছেই, ৫০ কেজির বস্তাতে বাড়ছে ২৫০-৩০০ টাকা। বাড়ছে বিশ্ববাজারেও। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও এই তেলের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু আর স্বাভাবিক থাকছে না।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যমূল্য সূচকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দর টানা পাঁচ মাস জুড়ে বেড়ে ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে বলে জানানো হয়। মে মাসের সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে এটি প্রকাশিত হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। জাপানি ব্যাংক নোমুরার প্রধান অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা জানান, চালের বাড়তি দাম মনিটর করতে হবে; কারণ গমের দাম বাড়ায় বিকল্প হিসেবে চালের প্রতি ঝুঁকবে মানুষ, এতে চাহিদা বাড়লে বিদ্যমান মজুদ কমবে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের তথ্যমতে, চীনে উৎপাদিত চালের পরিমাণ হচ্ছে ২৮ শতাংশ, ভারতে ২৩.৫, ইন্দোনেশিয়ায় ও বাংলাদেশ ৭.২, ভিয়েতনামে ৫.২, থাইল্যান্ড ৩.৭, মিয়ানমারে ৩.৫, ফিলিপাইন ২.৫, পাকিস্তান ১.৫, ব্রাজিল ১.৪ ও অন্যান্য ১৫ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ডেভিড ল্যাবরোড গত জুন মাসে বলেছিলেন, ভারত চাল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এর আগে গম ও চিনির ক্ষেত্রেও সেদেশের সরকার একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কেননা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে, বিশ্বের শীর্ষ দুই চাল উৎপাদক- ভারত ও চীন মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের অর্ধেক উৎপাদন করে। এ তালিকায় ভিয়েতনাম পঞ্চম ও থাইল্যান্ড ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে এক সপ্তাহ আগে গত ১ আগস্ট প্রতি কেজি সরু চাল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিলো ৪৮-৫০ টাকা দরে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, সরু চাল (মিনিকেট, নাজিরশাইল) ৭৬-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চাল (পাইজাম ও লতা) বিক্রি হচ্ছে ৫৭ টাকা থেকে ৬৩ টাকা আর মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না ও ইরি) চাল ৫১ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এশিয়ার দেশগুলো থেকে চালের ৯০ শতাংশ সরবরাহ বিশ্ববাজারে আসে। তবে রুক্ষ আবহাওয়ায় এবার সেই হিসেব বদলে যাবে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের কৃষি ব্যবসা বিষয়ক অর্থনীবিদ ফিন জিবেল বলেন, বড় রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কমছে, এতে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে, যা মূল্যস্ফীতির এ সময়ে আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। চালের দাম বাড়লে উন্নয়নশীল অনেক দেশেই খাদ্যের জোগান কঠিন হয়ে পড়বে। ভারতের উৎপাদক অঞ্চলগুলোতে কম বৃষ্টি, চীনে দাবদাহ, বাংলাদেশে বন্যা এবং ভিয়েতনামে বৃষ্টি ও বন্যায় ফসলহানি হওয়ায় এই চার দেশেই উৎপাদন ব্যাহত হবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতিবিদ শার্লি মুস্তফা বলেন, এ বছর সব খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও চালের জোগান ছিল ভালো; কিন্তু এখন দেখছি বৈরী আবহাওয়ায় ভারত, চীন ও বাংলাদেশে উৎপাদন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে ধান উৎপাদন কমবে।

বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে চলতি মৌসুমে ধান চাষের পরিমাণ কমেছে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে অন্যতম হলো পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশ। বৈশ্বিক চালের ৪০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। অল ইন্ডিয়া রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বি ভি কৃষ্ণ রাও বলেন, ‘ভারতে চাল উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১০ মিলিয়ন টন বা ৮ শতাংশ কমতে পারে। বিশ্বের শতাধিক দেশে চাল রপ্তানি করে ভারত। দেশটির প্রধান ক্রেতার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, নেপাল এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ।

ভিয়েতনামে আবাদকালীন বৃষ্টিপাতে ফসলহানি হয়েছে। দেশটির একজন কৃষক বলেন, বন্যায় আমার দুই হেক্টর জমির ৭০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। চালের সবচেয়ে বড় ভোক্তা ও আমদানিকারক দেশ চীন। ব্যাপক খরায় দেশটিতেও ফসলহানি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থা (ইউএসডিএ) জানায়, ২০২২-২৩ মৌসুমে চীনকে রেকর্ড ছয় মিলিয়ন টন চাল আমদানি করতে হবে। এর আগের বছর দেশটি আমদানি করে ৫.৯ মিলিয়ন টন।

বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভারতের পাশাপাশি চালের রপ্তানিমূল্য বাড়াবে থাইল্যান্ডও। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক ব্যবসায়ী জানান, ফিলিপাইন ও আফ্রিকার অন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে চালের চাহিদা বাড়ছে। তারা কার্গো বুক করছে। ফলে দাম আরো বাড়বে।

সংবাদটি শেয়ার করুন