চোখজুড়ানো সবুজ দিগন্ত বিলে গাড় সবুজ পাতার মাঝে হালকা গোলাপি রংয়ের পদ্ম ফুলের উঁকি। ফোটা পদ্মের সঙ্গে কুঁড়িগুলো মাথা তুলেছে নতুন করে ফোটার আশায়। সবুজ পাতা আর গোলাপি পদ্মের মিলন মেলায় মনের আনন্দে নির্ভয়ে বিচরণ করছে পানকৌড়ি আর ডাহুক। ফুটন্ত পদ্মের মাথায় খেলা করছে প্রজাপতি আর ভ্রমরের দল। প্রকৃতির এমন প্রেমের আলিঙ্গণের নয়নাভিরাম অপরূপ দৃশ্যের দেখা মিলেছে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের মটবাড়িয়া পদ্ম ফুলের বিলে। জেলার এ পদ্ম বিলটি বর্তমানে বুড়োর বিল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
হালকা গোলাপি রঙের পদ্ম ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য যেমন মানুষের মনকে আকর্ষণ করে তেমনি খাদ্য ও ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ এ ফুল অনেক জনপ্রিয়। পদ্ম ফুল অনেকের কাছে আবার বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতিক হিসেবে গণ্য।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের মাঠবাড়িয়া বুড়োর বিল। গত তিন দশক ধরে বর্ষাকালে এ বিলে ফোটে গোলাপী রঙের অসংখ্য পদ্ম ফুল। তবে গত দুই বছর ধরে প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এটি মাঠবাড়িয়ার পদ্মবিল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। অপরূপ এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
সরেজমিনে মটবাড়িয়া পদ্ম বিলে দেখা যায়, কয়েক একর পতিত জমিতে হাজার হাজার গোলাপি পদ্ম ফুল ফুটে আছে। পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর দূরান্ত থেকে প্রকৃতি প্রেমিরা ছুটে আসছেন। দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুড়োর বিলে। দেখতে আসা দর্শনার্থীরা নিজেদের স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছেন। প্রথম দিকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যেত। এতে বিলের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।
বালিয়াকান্দি থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী সুরজ মন্ডল বলেন, ঘুরতে এসে বুড়োর বিলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয়দের কাছে শুনেছি এখানে নাকি অনেক আগে থেকেই প্রাকৃতিকভাবে পদ্ম ফুল ফুটে। কয়েকজন বন্ধু মিলে পদ্ম ফুল দেখতে এসেছি। বিলের দৃশ্য সত্যি নয়নাভিরাম।
রাজবাড়ী শহর থেকে আসা মোস্তফা মুন্সি বলেন, এ বিল সাধারণত স্থানীয়দের কাছে বুড়োর বিল নামেই পরিচিত। বিলে প্রতি বছর অসংখ্য পদ্মফুল ফোটে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। আমি এ বিলে ফুটে থাকা পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে এসেছি।
পদ্মবিল পাড়ের বাসিন্দা রকিবুল হাসান বলেন, বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে মানুষ পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। তবে এখানে আসার যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না। তাই অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসতে পারেন না। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হলে এখানে অনেক পর্যটক আসবে। আমি জন্মের পর থেকেই এ বিলে পদ্ম ফোটা দেখছি। এটাকে অনেকে বুড়োর বিল বলে, আমরা বলি পদ্মবিল।
রাজবাড়ী জজ কোর্টের আইনজীবী অভিজিৎ সোম বলেন, ইসলামপুর ইউনিয়নের মঠবাড়িয়ার বিল। স্থানীয়দের কাছে এটি বুড়োর বিল নামে পরিচিত। এই বিলে প্রতিবছর অসংখ্য পদ্ম ফুল ফোটে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। আমি এই বিলে ফুটে থাকা পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে এসেছি। এসে খুবই ভালো লাগছে। তবে এই বিলে প্রবেশের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নৌকার ব্যবস্থা নেই। নৌকা থাকলে দর্শনার্থীরা ফুলের কাছে গিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতো। পাশাপাশি স্থানীয়রা নৌকা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারতো। নৌকার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মানুষ খালি পায়েই যতদূর সম্ভব বিলের মধ্যে গিয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখে ফিরে আসছে।
আরেক দর্শনার্থী হান্নান শেখ জানায়, তার বাড়ি পাবনা জেলায়। তিনি তার আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। গত কয়েক বছর আগে এ বিলে পদ্ম ফুল দেখার পর থেকে তিনি প্রতিবছর বর্ষার সময় এই বিলে আসার জন্য চেষ্টা করেন। গত বছর আসতে পারেন নাই তাই এবার এসেছেন। এক সঙ্গে শত শত ফুল দেখে তিনি খুবই আনন্দিত। তবে বিলে নৌকার ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো লাগতে তার।
স্থানীয় গোবিন্দ কুমার বিশ^াস বলেন, আমি জন্মের পর থেকেই এই বিলে পদ্ম ফোটা দেখছি। এটাকে বুড়োর বিল বলে, আমরা বলি পদ্ম বিল। এখানে অনেক মানুষ ঘুরতে আসে, ছবি তোলে।
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের জীব বিজ্ঞানের প্রভাষক আব্দুল্লাহীল হাসান বলেন, পদ্ম একটি জলজ উদ্ভিদ। ভারতীয় উপ মহাদেশে সাধারণত তিন ধরনের পদ্ম ফুল দেখতে পাই লাল পদ্ম, শে^ত পদ্ম ও নীল পদ্ম। নীল পদ্ম যদিও দেখা যায় না বললেই চলে। সাধারণত নীল পদ্ম আমরা গল্প উপন্যাসে পেয়ে থাকি। একটা সময় আমাদের দেশে অনেক পদ্ম দেখা যেত। তবে, বর্তমান সময় বিল জলাশয় ভরাট করে ফেলার কারণে পদ্ম ফুল বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। পদ্মফুল আমাদের জন্য অনেকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, ওষুধীগুণসহ নানা ভাবে গুরুত্ব বহন করে।
আব্দুল্লাহীল হাসান আরও বলেন, পদ্ম ফুল দেখলেই ধরতে ইচ্ছা করে, ছুতে ইচ্ছা করে। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের বুড়োর বিলে যে পদ্ম ফুল পাওয়া যায় এটির প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো যারা দর্শনার্থী যাবেন দয়া করে এই ফুল গুলো ছিড়বেন না, নষ্ট করবেন না। আমরা যদি প্রকৃতি কে ভালোবাসি। প্রকৃতির প্রেমে যদি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই তাহলে এ প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা নষ্ট করবো না।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা জানান, ইসলামপুর ইউনিয়নের মঠবাড়িয়া পদ্মবিলে গত দুই বছর ধরে শত শত পদ্ম ফুল ফুটতে দেখা যাচ্ছে। যেহেতু সম্প্রতি ফুল ফুটতে শুরু করেছে, সেহেতু এখন পর্যন্ত পদ্ম ফুল সংরক্ষণের জন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তবে ভবিষতে কোনো পরিকল্পনা গ্রহন করা যায় কি না সেটা বিবেচনা করা হচ্ছে।