ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রবিজয় বাংলাদেশের বড় অর্জন। গত ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং দুবছর পর ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে দেশের সমুদ্রসীমানা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ ও নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তবে বিজয়ের প্রায় এক দশকেও বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক ইজারা দেয়ার সুযোগ থাকলেও সে ব্যাপারে অগ্রগতি হয়নি। সঠিক সময়ে সুযোগ কাজে লাগাতে না পারায় সমুদ্র সম্পদ আহরণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
দেশের সম্ভাব্য গ্যাস ক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য উল্লেখ করে খ্যাতিমান ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরূল ইমাম বলছেন, দেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ টিসিএফ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভাণ্ডার বিদ্যমান রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস জিউলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দু’বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত, এ দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের পরিমাণ কম-বেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে।
নরওয়ে সরকারের অধীন নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরক্টেরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের সঙ্গে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র্যাম্বল নামের ইউরোপিয়ান তেল ও গ্যাস কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরে ড. বদরূল ইমাম জানান, ভারতের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে যেখানে এরই মধ্যে ১৫০টি গ্যাসকূপ খনন করে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, সেখানে ত্রিপুরার ১৫ গুণ বড় আয়তনের বাংলাদেশের স্থলভাগে গত ৫১ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে একশর কম। অথচ এত কম অনুসন্ধান কূপ খনন করেও বাংলাদেশে ত্রিপুরার চেয়ে অনেক বেশি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার এক-তৃতীয়াংশেরও কম এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়েছে অথচ বিশ্বের গড়ের চেয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্ত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা অনেক বেশি।
এগিয়ে ভারত-মিয়ানমার
২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার দ্রুত গ্যাস ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। ২০১৬ সালে থালিন-১ নামক ব্লকে এ গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা দেয় মিয়ানমার। থালিন-১-এ সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে। এখান থেকে গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে। মিয়ানমার ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে।
সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে পিছিয়ে নেই ভারতও। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাভরী বেসিন এলাকায় ভালো পরিমাণ গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে বলে আশা করছে ভারত। দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি গ্রুপ রিলায়েন্স এই এলাকায় জোরালো অনুসন্ধান কাজ করেছে।
এর আগে বঙ্গোপসাগরের শুধুমাত্র সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলা হয়েছে। এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯৬ সালে আবিষ্কার করে ব্রিটিশ তেল-গ্যাস কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। সাঙ্গু আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃশেষ ও পরিত্যক্ত হয় ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। এরপর সাগরের আর কোনও ক্ষেত্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান করা হয়নি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর বলেছিলেন, মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের প্রয়োজন আছে। যেকোনও বিদেশি কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখালে তাকে যদি সেখানে কী আছে সে বিষয়ে একটি ধারণা দেওয়া যায়, তাহলে কাজের অনেক সুবিধা হয়। এছাড়া এই ধরনের জরিপ করা গেলে নিজেদেরও ধারণা হবে যে আসলে আমাদের সাগরে কী ধরনের সম্পদ আছে।
গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নিয়ে প্রশ্ন
দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গঠন করা হয়েছিল গ্যাস উন্নয়ন তহবিল। সেই তহবিলের টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে এলএনজি আমদানিতে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এলএনজি আমদানির জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়ার অনুমোদন পেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় গত ৬ জুলাই এ ঋণের বিষয়ে সম্মতি দেয়। এ-সংক্রান্ত চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে সাময়িকভাবে ঋণ প্রদানের সম্মতি দেওয়া হলো।
দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গঠন করা তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে এলএনজি আমদানি করা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে যতটুকু জোর দেওয়ার দরকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি, বরং আগ্রহই ছিল গ্যাস আমদানিতে।
এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য মকবুল ই ইলাহী বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে ভোক্তার টাকায়। এ তহবিল থেকে অর্থ নিতে কমিশনের অনুমতি নিতে হয়। এলএনজি কিনতে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি কমিশনের জানা নেই।
অন্যদিকে, ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এই টাকাটা আসলে ঋণের নামে নিয়ে নেওয়া হলো। ভোক্তারা এটিকে বৈধ মনে করে না। তিনি বলেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দিয়ে আমদানির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন দৈনিক ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যা বছর দুয়েক আগেও ২৭০ কোটি ঘনফুট ছিল। সরকার কয়েক মাস আগেও বিদেশ থেকে আমদানি করে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করতো।
৫০ কোটি ঘনফুট আসে কাতার এবং ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। আর বাকি ৩৫ কোটি ঘনফুট খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে কেনা হতো, যা আপাতত বন্ধ রয়েছে। কারণ, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এদিকে গত জুনে বিইআরসি এক দফা বাড়িয়েছে গ্যাসের দাম।
আনন্দবাজার/শহক