প্রাণঘাতী সব রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে
–সৌম্য স্বামীনাথন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডব্লিউএইচও
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির পর এবার বিপদ বাড়াচ্ছে স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির আরেকটি ভাইরাস মাঙ্কিপক্স। এই ভাইরাসটিও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এতে গোটা বিশ্বেই স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গত ২৪ জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারির ঘোষণা দিয়েছেন ডাব্লিউএইচও-এর প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৫টি দেশে ১৮ হাজারেরও বেশি জনের মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া গেছে। আর আক্রান্তদের বেশিরভাগই পুরুষ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত পাঁচজন মারা গেছেন। ইউরোপ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার মধ্যম ঝুঁকি রয়েছে। তবে ইউরোপে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি উচ্চ। সম্প্রতি ভারতেও দু’জনের মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির জেরে মাঙ্কিপক্সকে গ্লোবাল হেলথ ইমার্জেন্সি বা বিশ্ব স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তবে সংক্রামক এই ভাইরাসটি কীভাবে একে-অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ মোকাবিলায় পুরুষদের সেক্স পার্টনারের সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ২৭ জুলাই রাতে বার্তাসংস্থা এএফপি এবং সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত যেসব পুরুষ অন্য পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে তাদের প্রতি এই আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর আগে মাঙ্কিপক্সের বিষয়ে আলোচনার জন্য দুই দফায় বৈঠক করে ডব্লিউএইচও। বর্তমানে এ ধরনের আরও দুটি স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি আছে। একটি হলো করোনাভাইরাস মহামারী, অন্যটি পোলিও নির্মূল। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর সূত্রমতে, মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কে বানরের দেহে প্রথম এ রোগ শনাক্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা ও ফুসকুড়ি উঠে যেতে পারে। সাধারণত জ্বরের তিন দিনের মধ্যে এ ফুসকুড়ি ওঠে। উপসর্গ দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণকে ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ডব্লিউএইচওর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌম্য স্বামীনাথন। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার এ ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। কারণ, সব সময় আমাদের প্রাণঘাতী সব রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের চেয়ে মাঙ্কিপক্স ভয়াবহ হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, দুটি ভাইরাসের সরাসরি তুলনা করা যাবে না। কারণ, তথ্যের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার যে মাঙ্কিপক্স একটি আলাদা ভাইরাস। আর এটা করোনার মতো একই গতিতে রূপান্তরিত হয় না।
১৯৭৯-৮০ সাল থেকেই স্মলপক্সের টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই কর্মকর্তা বলেন, আজ আমাদের হাতে স্মলপক্সের যে টিকা রয়েছে তা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের। তবে এই টিকার খুবই সীমিত ডোজ রয়েছে। স্মলপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে, এই শঙ্কা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এর টিকা মজুত করছে। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ‘বাভারিয়ান নরডিক’ নামের ডেনমার্কভিত্তিক একটি কোম্পানি মাঙ্কিপক্সের টিকা তৈরি করেছে। তবে ওই টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো তথ্য হাতে নেই। আমাদের জরুরিভিত্তিতে এই তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
জাপানে প্রথম মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত
জাপানে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বিদেশ ঘুরে আসা ওই ব্যক্তির বয়স ৩০-এর কোঠায়। গত ২৫ জুলাই দেশটির রাজধানী টোকিওর গভর্নর ইউরিকো কোইকে জাপানে এই মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্তের ঘোষণা দিয়েছেন। কোইকে বলেছেন, ওই ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ইউরোপ থেকে ফিরেছেন। জাপানে এটাই প্রথম মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা। ওই ব্যক্তি বর্তমানে টোকিওর একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেননি টোকিওর এই গভর্নর। তথ্য সংগ্রহ, ক্লিনিকে রোগীদের পরীক্ষা ও ভর্তির জন্য জাপানের সরকার টাস্কফোর্সের এক বৈঠক ডাকার কয়েক ঘণ্টা পরই দেশটিতে মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাল সংক্রমণজনিত এই রোগটি পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকায় সাধারণত সবচেয়ে বেশি দেখা গেলেও চলতি বছর সেই গণ্ডি পেরিয়েছে। গত ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। নাইজেরিয়া থেকে ওই ব্যক্তি ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন।
সিডিসি কারও শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আইসোলেশনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তবে বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হওয়া লোকজনের মাঝে- এমন অনেক পুরুষ আছেন, যারা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছেন। স্পেনের মাদ্রিদ অঞ্চলের সাউনার কয়েকটি ঘটনায় এ ধরনের শারীরিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত বিশ্বের ১৬টি দেশের ৫২৮ জন মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ রোগীর শরীরে যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ ঘটেছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরের গবেষণা।
ইইউ’র ইমভানেক্স টিকার অনুমোদন
মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় নতুন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পর এবার ইউরোপের দেশগুলোর জন্য এই টিকার অনুমোদন দিলো সংস্থাটি। গত ২৫ জুলাই এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসাবে ইমভানেক্স ভ্যাকসিন বাজারজাত করতে ইউরোপীয় কমিশন অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছে ড্যানিশ বায়োটেকনোলজি কোম্পানি বাভারিয়ান নর্ডিক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপীয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) গত সপ্তাহে এই টিকার অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছিল।
নর্ডিক-এর প্রধান নির্বাহী পল চ্যাপলিন বলেছেন, একটি অনুমোদিত ভ্যাকসিনের উপস্থিতি (মাঙ্কিপক্সের মতো) উদীয়মান রোগগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশগুলোর প্রস্তুতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে। তবে তা শুধুমাত্র বিনিয়োগ এবং জৈবিক প্রস্তুতির কাঠামোগত পরিকল্পনার মাধ্যমে হতে হবে।
অবশ্য রয়টার্স বলছে, মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ইমভানেক্স তথা বাভারিয়ানের ভ্যাকসিনই একমাত্র টিকা যেটা যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র গুটিবসন্তের চিকিৎসার জন্য এই টিকা অনুমোদিত হয়েছে। রয়টার্স বলছে, মাঙ্কিপক্স ভ্যাকসিনের ব্যাপক চাহিদার কারণে বাভারিয়ানের শেয়ারের দাম গত তিন মাসে বেড়েছে ১২২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটির দু’টি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে- মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান। যুক্তরাষ্ট্রের একজন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, এই ভাইরাল সংক্রমণের সঙ্গে গুটিবসন্তের সম্পর্ক আছে। তবে সংক্রমণ সাধারণত মৃদু হয়। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকান ভাইরাসের প্রজাতিটি মৃদু ধরনের; যা যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্ত হয়েছে। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার প্রায় ১ শতাংশ।
বেশিরভাগ মানুষ দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
৯৫ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়েছে যৌনতার মাধ্যমে মাঙ্কিপক্সের ৯৫ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়েছে যৌন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে। এতে যৌনাঙ্গে একক ক্ষতের মতো নতুন ক্লিনিকাল লক্ষণগুলোর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ নিয়ে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। মূলত মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই গবেষণাটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরা এই প্রাদুর্ভাবেকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করবেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
এএফপি বলছে, লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। গবেষণায় চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬টি দেশের ৫২৮ জন মাঙ্কিপক্স রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণার প্রথম লেখক জন থর্নহিল বলেছেন, ‘এটি জোর দিয়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, ঐতিহ্যগত অর্থে মাঙ্কিপক্স এমন কোনো যৌন সংক্রামক রোগ নয় যেটি যেকোনো ধরনের ঘনিষ্ঠ শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। তবে, আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের বেশিরভাগ সংক্রমণ যৌন ক্রিয়াকলাপের সাথে সম্পর্কিত ছিল- প্রধানত যেসব পুরুষ অন্য পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করেছেন।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত ৯৮ শতাংশই সমকামী বা উভকামী পুরুষ। আক্রান্তদের ৪১ শতাংশের এইচআইভি ছিল এবং গড় বয়স ৩৮ বছর। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত এসব মানুষের আগের তিন মাসে তাদের যৌন সঙ্গীর গড় সংখ্যা ছিল পাঁচ জন।
আনন্দবাজার/শহক