উন্নয়নশীল ৮টি দেশ নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা ডি-৮ দেশগুলোর শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্লকে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আসুন, একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একত্রে কাজ করি। গতকাল বুধবার ঢাকায় অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক জোট ডি-৮-এর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন এবং ডি-৮ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ২০তম অধিবেশনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ভাষণে তিনি এই আহ্বান জানান। সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ডি-৮ মূলত বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্ক নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোট। প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব রেখে বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) প্রয়োগ করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মাধ্যমে ব্যবসায়িক সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং পরবর্তী দশকে ১২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে আন্ত-ডি-৮ বাণিজ্য দ্বিগুণ করার সুযোগ রয়েছে।
সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটি উদযাপন করায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ডি-৮ এখন সমন্বয় তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করতে প্রস্তুত। রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতের অর্থপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমাদের অপার সম্ভাবনা যদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়, তাহলে একটি অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে শক্তি বৃদ্ধি পাবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও তুরস্কের মতো অন্তর্ভুক্ত ডি-৮ দেশগুলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করছে শুনে আমি আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, এটি আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। বাধাগুলো উদারীকরণ এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে উদ্দীপিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিতীয় ডি-৮ সিসিআই সাধারণ অধিবেশনে এবং বিজনেস এক্সপোতে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের চেম্বারের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে সময় আমরা সবাই কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত ছিলাম, সে সময় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে বিপদে ঠেলে দিয়েছে। সংঘাত এবং পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা খাদ্য, সার, শক্তি ও বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি বহন করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অধিকাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমাদের সবার উচিত সাহসের সঙ্গে এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডি-৮ দেশ ছয়টি বঞ্চিত এলাকায় সহযোগিতা করছে।’ প্রধানমন্ত্রী ডি-৮ নেতাদের বিবেচনায় নেওয়ার জন্য পাঁচটি প্রস্তাব রাখেন। কারণ, ডি-৮ তার ২৫তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। ‘এটির আগামী দশকের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ফোকাস ক্ষেত্র তৈরি করা উচিত।’
প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘পিটিএ বাস্তবায়ন একটি সফল ডি-৮-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কারণ, দেশগুলোর বড় দেশীয় বাজার এবং একটি সম্মিলিত বাজার রয়েছে, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্ত-ডি-৮ বাণিজ্য আমাদের ব্যবসার সম্ভাবনা এবং সুযোগগুলোকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে। আগামী দশকে ১২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে আন্ত-ডি-৮ বাণিজ্য দ্বিগুণ করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সদস্য দেশগুলোর বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা দিতে প্রস্তুত। আমরা যদি এখনই প্রক্রিয়া শুরু করি, তাহলে আগামী দশকের মধ্যে আমাদের একটি শক্তিশালী ডি-৮ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইসিটি এমন একটি ক্ষেত্র যার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ডি-৮ দেশের যুবকদের শক্তিশালী কর্মশক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ৪০ বছরের নিচে এবং আমাদের সাড়ে ৬ লাখ নিবন্ধিত আইটি ফ্রিল্যান্সার রয়েছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা আইটিভিত্তিক শিল্প তৈরি করতে এবং তরুণদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে পারি।’
চতুর্থ প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ডি-৮-এর বৈচিত্র্যময় কৃষি উৎপাদনে মনোনিবেশ করা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ তার সেরা অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা অন্যান্য ডি-৮ সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত। আগামী দশকের মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের কৃষি উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
পঞ্চম এবং চূড়ান্ত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্ত ডি-৮ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প শক্তির উৎসগুলোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ ‘আমি প্রস্তাব করি যে ডি-৮ বিকল্প শক্তিতে দক্ষতা আছে এমন অন্যান্য দেশকে সম্পৃক্ত করে সক্ষমতা বিকাশের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে’, তিনি যোগ করেন।
১৯৯৭ সালের ১৫ জুন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ইস্তাম্বুল ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ডি-৮ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, ডি-৮ মহাসচিব রাষ্ট্রদূত ইসিয়াকা আব্দুল কাদির ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এবং ডি-৮ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডি-৮সিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বক্তব্য রাখেন।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। অনুষ্ঠানে ডি-৮-এর ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।