রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান- পর্ব-২

বায়োগ্যাসে বড় স্বপ্ন

বায়োগ্যাসে বড় স্বপ্ন
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণমুক্ত বাসযোগ্য বিশ্ব গড়তে উন্নত দেশগুলো এখন সরব হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক শক্তি সংকট দিন দিন ভয়াবহ হয়ে ওঠায় দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। ইতোমধ্যে বহু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে সময় বেঁধে দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। তবে শক্তি সংকটের ভয়াবহতার মধ্যেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমানে অপার সম্ভাবনা। শুধু সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ আর সময় উপযোগী উদ্যোগ নিলেই সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি সংকট থেকে আমরা বেরুতে পারবো। বিকল্প জ্বালানির সন্ধান নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব- নাঈম কামালের জ্বালানি সংকটে বায়োগ্যাস।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের সংকট। ‘স্পট মার্কেট’ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ। এতে বহুমুখী সংকটে পড়েছে দেশের গ্যাসখাত। যে কারণে সম্প্রতি উৎপাদনে যেতে পারেনি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে দেশব্যাপী লোডশেডিং বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে এ সংকট দিন দিন বাড়বে। তাই সংকট আরও প্রকট হওয়ার আগেই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস সংকট নিরসনে উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প যে নেই তা বলাই বাহুল্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র পড়ে থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ বা সাফল্য নেই। এমন অবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমানো খুবই জরুরি। আর এ কাজটি করা যেতে পারে দেশে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে। বায়োগ্যাস হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এর ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার মাধ্যমে সহজেই প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমানো সম্ভব।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও জোর দিচ্ছে বায়োগ্যাস উৎপাদনে। মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র থেকে শুরু করে ঘাস এবং লতাপাতাও হতে পারে এই গ্যাসের কাঁচামাল। চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে বড় পরিসরে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। বায়োগ্যাস মূলত আসে বায়োজাত বা প্রাকৃতিক বস্তু থেকে। জার্মানির বায়োগ্যাস প্ল্যান্টগুলোতেও এইসব উপাদান ব্যবহার করে গ্যাস উৎপাদন করা হয়। জার্মানিতে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে বাণিজ্যিক বায়োগ্যাস কারখানা। এসব কারখানা থেকে গ্যাস পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে। এতে যোগান বাড়ছে দেশটির বিদ্যুতে। পাশাপাশি উৎপাদন হচ্ছে জৈব জ্বালানি ও উৎকৃষ্টমানের সার।

আরও পড়ুনঃ  আধুনিকতার ছোয়ায় বিলুপ্ত খেজুর পাটি

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বায়োগ্যাসে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। বহু আগেই দেশে বায়োগ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়। তথ্যমতে, ১৯৭২ সালে দেশে প্রথম বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে শহর ও গ্রামে সমানতালে জনপ্রিয় হতে থাকে। এর একটি বিশেষ কারণ হল, বায়োগ্যাস উৎপাদনের পর এর অবশিষ্টাংশ শস্যক্ষেত ও মাছের পুকুরে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে ৫৫-৬৫ ভাগ মিথেন গ্যাস, ৩০-৪০ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং সামান্য পরিমাণ নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড উৎপাদিত হয়।

তথ্যমতে, সাধারণত এক কিউবিক মিটার বায়োগ্যাস থেকে ৫৫০০-৬৫০০ কিলোক্যালরি তাপশক্তি পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, দেশে প্রতিদিন গৃহস্থালি, খামারসহ অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ১৬ হাজার ৮৩০ টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে বছরে বর্জ্য তৈরি হয় প্রায় ৫ হাজার ৮৪০ লাখ টন।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে দেশে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার টন। এসব বর্জ্য থেকে যদি বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায় তাহলে শুধু জ্বালানি সংকটই কাটবে না, সঠিক ব্যবস্থাপনায় একটি আধুনিক পরিবেশবান্ধব নগরও গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি মুরগির বর্জ্য থেকে ২৭ দশমিক ২০ মিলিলিটার, প্রতি কেজি গরুর বর্জ্য থেকে ২ দশমিক ৫০ মিলিলিটার এবং প্রতি কেজি ছাগলের বর্জ্য থেকে ৩৯ মিলিলিটার এবং গরু, ছাগল ও মুরগির সমন্বিত বর্জ্য থেকে ৭৪ দশমিক ১০ মিলিলিটার বায়োগ্যাস বা মিথেন পাওয়া সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এসব বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ  হজ ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হবে

আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে প্রতিটি গরু থেকে ৬ দশমিক ৭৭ কেজি মিথেন, প্রতিটি মহিষ থেকে ৫ দশমিক ২৪ কেজি মিথেন, প্রতিটি ছাগল বা ভেড়া থেকে শূন্য দশমিক ২০৩ কেজি এবং প্রতিটি মুরগি বা হাঁস থেকে শূন্য দশমিক ২৪ কেজি মিথেন নির্গত হয়, যেখানে প্রতি ১৫ কেজি পাকস্থলীর বর্জ্য থেকে প্রায় এক ঘনমিটার বায়োগ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এ ছাড়া বায়োগ্যাস প্লান্টের পরিশিষ্ট বর্জ্য পিলেট আকারে মাছের খামারে ও কৃষিজমিতে সার হিসেবে ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ এর কোনো অংশই বিফলে যাবে না।

অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে প্রায় ৭৬ হাজারেরও বেশি বায়োগ্যাস প্লান্ট গড়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে বছরে ৩০ হাজার টন জৈবসার উৎপাদন হচ্ছে এবং এটি যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হয় তবে তা দিয়ে ১ লাখ হেক্টর জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমেই শতকরা ৩০ শতাংশ রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসবে। এ ছাড়া যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে রান্নাবান্নার কাজে কাঠ, খড়-কুটা, নাড়া, শুকনো গোবর এগুলোই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিবছর দেশে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন এ জাতীয় জ্বালানির প্রয়োজন।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বায়োগ্যাস ব্যবহারের অনেক সুবিধা রয়েছে। বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রধান দুটি কাঁচামাল গোবর এবং কচুরিপানা। এ উপাদানগুলো প্রায় সব গ্রামেই সহজলভ্য। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প হতে পারে। বলা হচ্ছে মাত্র ১/২ কেজি গোবরে উৎপাদিত বায়োগ্যাস দিয়ে একটি সাধারণ পরিবারের দৈনন্দিন রান্নাবান্নার কাজ করা সম্ভব। কিন্তু এরপরেও আমাদের দেশে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস এখনও ততোটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি।

আরও পড়ুনঃ  জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিক্ষোভে নিহত ১০৬

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গরু-মহিষ রয়েছে কমপক্ষে আড়াই কোটি। সে হিসেবে বায়োগ্যাসের ব্যাপক কাঁচামাল রয়েছে। এছাড়াও ব্যাপক ভিত্তিতে গরু-মহিষ ও হাঁস-মুরগির খামার করে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমানো সম্ভব। এত সম্ভাবনার মুখেও বায়োগ্যাস কেন বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে না সে বিষয়ে কিছু নেতিবাচক দিক রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ মনে করে পচনশীল পদার্থ ও আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস তৈরি হয়। রান্নাবান্নায় বায়োগ্যাসের ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তবে এসব ধারণা পুরোটাই ভুল। ভুল ধারণার কারণেই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাসের জনপ্রিয় থমকে আছে। তবে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভ্রান্ত ধারণা দূর হলেই বায়োগ্যাস বড় স্বপ্ন পূরণ করতে পারে জ্বালানি সংকটে। তবে এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগ।

গ্রামীণ শক্তিসহ বেশ কিছু এনজিও গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস ব্যবহারের প্রসারে ভূমিকা রাখছে। তবে এসব উদ্যোগ যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, আরেকটু চেষ্টা ও উদ্যোগ থাকলে বায়োগ্যাস জনপ্রিয়করণের মাধ্যমে বদলে দেয়া যাবে গ্রামীণ জনপদের জীবনধারা। কারণ, বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামে বসেই শহরের নাগরিক সুবিধা ভোগ করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরাঞ্চলেও বড় ধরনের বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সমস্যা কাটানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাঁচামাল হিসেবে শিল্প কারখানা বর্জ্য, মিউনিসিপ্যাল বর্জ্যের জৈব অংশ ব্যবহার করা যেতে পারে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন